নোয়াখালীতে এখনও ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি, ৩ জনের মৃত্যু
বাংলাদেশ

নোয়াখালীতে এখনও ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি, ৩ জনের মৃত্যু

নোয়াখালীতে শুক্রবার থেকে উঁকি দেয় সূর্য। শনিবারও দিনভর থেমে থেমে ছিল রোদ। কিছু কিছু এলাকা মেঘ জমলেও বৃষ্টি হয়নি। শনিবার বৃষ্টি না হওয়ায় কিছু এলাকায় কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। বৃষ্টি না হলেও এখনও বেশিরভাগ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। উজান থেকে এখনও ধীরগতিতে আসছে স্রোত। এখনও প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। বিশেষ করে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন অনেকে। বেশিরভাগ মানুষের ঘরবাড়ি এখনও ডুবে আছে। বন্যার মধ্যে এ পর্যন্ত জেলায় পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।

শনিবার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা জজ আদালত, চিফ ‍জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সড়কসহ জেলা শহর মাইজদীর প্রায় সব সড়ক হাঁটুপানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। শহরের বেশিরভাগ বাসাবাড়িতেও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। শহরের সড়কগুলোতে রিকশা, অটোরিকশার চলাচলও কম। হেঁটে পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন মানুষজন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, জেলার ৯ উপজেলার সবকটিতেই বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে। এতে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। খাল উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশনে সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে স্থানীয়রা। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বন্যা আক্রান্ত এলাকাগুলোতে। বেড়েছে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগী। রোগীদের চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের হিমশিম খাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা সদর, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর উপজেলার বেশিরভাগ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন এসব উপজেলার বাসিন্দারা। বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে আমন ধানের বীজতলা, শাকসবজি এবং ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। এ ছাড়া দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক উচ্চতায় জোয়ার হয়েছে।

সদর উপজেলায় এখনও মানুষের আতঙ্ক কমেনি। গত দুই দিন বৃষ্টি হয়নি। তবুও কমেনি বন্যার পানি। পানি জমে থাকায় দুর্গত এলাকায় শিশুদের ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি না থাকায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বসতঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে অনেকে ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

সদর উপজেলার শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা রাজিব আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘বন্যার পানি এখনও কমেনি। এলাকায় এখনও অনেকে পানিবন্দি হয়ে আছেন। আমাদের দুর্ভোগের শেষ নেই।’

চাটখিল উপজেলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার স্যালাইনসহ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে। উপজেলার সব বহুতল প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা ভবনগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং এলাকার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত শুকনো খাবারসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি  সরবরাহ করে যাচ্ছে। ত্রাণ বিতরণে উপজেলা প্রশাসনসহ সেনাবাহিনী সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

বেগমগঞ্জ উপজেলায় ভারতীয় বন্যার পানি বাড়ছে এখনও। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে জনমনে। পানি বাড়ছে সেনবাগ আর সোনাইমুড়ীতেও। কবিরহাট উপজেলায়ও বন্যার পানি এখনও অপরিবর্তিত আছে।

বেগমগঞ্জ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অসীম কুমার দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেগমগঞ্জে বন্যাকবলিত এলাকায় পৃথকভাবে ৪৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। বর্তমানে পানি নামতে শুরু করায় ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালে ২৫ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি রয়েছেন। তাদের খাবার স্যালাইনসহ সব প্রকার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের ওষুধের সংকট নেই। তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’

সুবর্ণচরে শনিবার সারাদিন রোদ ছিল। এতে জমে থাকা পানি অনেক কমে গেছে। উপজেলার পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের কৃষক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ধানের বীজ রোপণ করেছি। বীজগুলো সম্পূর্ণ পানির নিচে রয়েছে। আজ বৃষ্টি হয়নি। এখন আল্লাহর রহমতের দিকে তাকিয়ে আছি। সামনের মৌসুমে কী হবে জানি না।’

একই উপজেলার চর ওয়াপদা ইউনিয়নের আবদুল হক বলেন, ‘মাঠে শাক-সবজির চাষ করেছি। এখন পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখনও পানি পুরোপুরি নামেনি। আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।’

সুবর্ণচর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আল অমিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৃষ্টিপাত, জোয়ার ও ফেনী থেকে আসা পানির চাপ সব মিলিয়ে বন্যা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছিল। শুক্রবার এবং শনিবার বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।’

সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিসান বিন মাজেদ বলেন, ‘সেনবাগের বন্যা পরিস্থিতি আগের দিনের তুলনায় অবনতি হয়েছে। ফেনী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। উপজেলার ১২৫টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে এরই মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই বেলা খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করা হচ্ছে। তবে এখানে শুকনো খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে।’

চাটখিলের ইউএনও কাজী এহসান উদ্দিন বলেন, ‘চাটখিলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের সব কটি বন্যার পানিতে প্লাবিত অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন প্রায় সাত হাজার মানুষ। পানি নামছে না বরং পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জায়েদ হাসান খান বলেন, ‘জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এ পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুজন সেনবাগ এবং একজন সদর এলাকার বাসিন্দা।’

বন্যাকবলিত এসব মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন জেলা প্রশাসন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দেশেরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। তবে এখনও অনেক জায়গায় সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন বানভাসি মানুষজন।

Source link

Related posts

স্ত্রী ও চার সন্তানকে হারিয়ে একা হয়ে গেলেন প্রবাসী নারায়ণ

News Desk

বৈশাখের খরতাপে ‘শীতের কুয়াশা’

News Desk

রংপুর চিড়িয়াখানায় ৫ বছর পর এলো বাঘ দম্পতি

News Desk

Leave a Comment