মামলার বিচারকাজ স্থগিত ছয় বছর ধরে
বাংলাদেশ

মামলার বিচারকাজ স্থগিত ছয় বছর ধরে

২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারিতে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বাতাসন দূর্গাপুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা মেরে শিশুসহ ছয় যাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এতে দগ্ধ হয়েছিলেন আরও ২৫ জন যাত্রী। এই মর্মান্তিক ঘটনার ১০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। ২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের দেওয়া এক আদেশে মামলার সকল কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে আইনগত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি উদ্যোগী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয় আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা। তারা জানান, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে বারবার জানানোর পরেও উদ্যোগ গ্রহণ না করায় মামলাটির স্থগিতাদেশের শুনানি হচ্ছে না। এতে হতাশা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা।

যেভাবে বাসে আগুন দেওয়া হয়েছিল

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। ১৪ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে ছেড়ে আসা খলিল পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকার উদ্দেশে রংপুরের বাতাসন এলাকায় পৌঁছালে আগে থেকে ওতপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা চলন্ত বাসে বেশ কয়েকটি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। এতে পুরো বাসে আগুন ধরে যায়। বাসের ভেতরে থাকা শিশুসহ ছয় যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন কমপক্ষে ২৫ যাত্রী। গুরুতর আহতদের রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। আহতদের অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকে আগুনে দগ্ধের স্মৃতি ও ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। ওই বাসের বেশিরভাগ যাত্রীই সহায়সম্বলহীন ছিলেন। তারা কাজের সন্ধানে ঢাকা যাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছিল পুলিশ।

পুলিশি কার্যক্রম বিচার

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার জানান, এ ঘটনায় পুলিশের এসআই আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে ৮৭ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে মিঠাপুকুর থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করেন। পরবর্তীতে তদন্ত করে মিঠাপুকুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নজরুল ইসলাম ১৩২ জনের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলাটির বিচার রংপুরের অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ আদালত ১-এ শুরু হয়। ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৪ জনের সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়েছে। কিন্তু তদন্তজনিত ত্রুটির উল্লেখ করে আসামিপক্ষ হাইকোর্টে মামলাটির কোয়াশম্যান্টের (খারিজ) আবেদন করলে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ (স্টে অর্ডার) দেয়। এতে মামলার বিচার কার্যক্রম ২০১৭ সাল থেকে স্থগিত রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইনজীবী জানান, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় মামলাটির শুনানির উদ্যোগ নিলে দীর্ঘ ৬ বছর এভাবে মামলাটি ঝুলে থাকতো না। কবে স্থগিতাদেশ শুনানি হবে তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বহাল থাকায় মামলার কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।

সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা যা বলছেন

এ ব্যাপারে সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অন্যতম আইনজীবী অতিরিক্ত পিপি আব্দুস সাত্তার জানান, মামলাটির বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। কিন্তু আসামিপক্ষ হাইকোর্টে কোয়াশম্যান্টের জন্য আবেদন করায় মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তবে হাইকোর্টে শুনানি শেষ হলে খুব দ্রুতই বিচারকাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অপরদিকে সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী প্রধান আইনজীবী পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এবং রংপুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক জানান, এরইমধ্যে মামলার বাদীসহ ৪৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি রয়েছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্বীকার করেন যে মামলার তদন্তকাজে ত্রুটি থাকার সুযোগ নিয়েছে আসামিপক্ষ। তারা হাইকোর্টে মামলাটি খারিজ করার আবেদন করলে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। এতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তিনি জানান, হাইকোর্টে যাতে দ্রুত শুনানি করা হয় সে জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ বাতিলের আদেশ পাওয়া গেলে নিম্ন আদালতে বিচারকাজ আবার চালু করা সম্ভব হবে।

এ ব্যাপারে রংপুর আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী নাম প্রকাশ না করে বলেন, মামলাটির শুনানির জন্য হাইকোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় উদ্যোগ নিলে স্টে অর্ডার (স্থগিতাদেশ) বাতিল হয়ে যাবে। এখন তো সন্ত্রাস দমন আইনের মামলার বিচারের জন্য আলাদা আদালত হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ আর মাত্র ৪-৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য হলেই দ্রুত রায়ের দিকে যেতে পারবেন বিচারক। কিন্তু স্থগিতাদেশের শুনানি কেন করা হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়।

তদন্তে গোঁজামিলের অভিযোগ

রংপুর পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা জানান, তৎকালীন তদারককারী ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অতিউৎসাহের কারণে মামলাটিতে আসামির সংখ্যা অহেতুক বেশি দেখানো হয়েছিল। মামলাটি ভালোভাবে তদন্ত করা হয়নি— বাদী আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ৩/৪ জন ছাড়া বাকি আসামিদের নামও বলতে পারেননি।

মামলা পরিচালনাকারী সরকারপক্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইনজীবী জানান, পুলিশ মামলাটি তদন্ত করার সময় এবং চার্জশিট দাখিলের সময় তাদের থেকে পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মানবাধিকারকর্মীদের যত অভিযোগ

মিঠাপুকুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোজাম্মেল হক মিন্টু অভিযোগ করে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট সারাদেশে অবরোধের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকাগামী বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে শিশুসহ ৬ বাসযাত্রীকে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করে। গুরুতর আহত হয় অনেকেই। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়েছে। আর কয়েকজনের সাক্ষ্য নেওয়া গেলেই রায়ের হয়ে যেতো। আসামিরা নিশ্চিত সাজা হবে জেনে ছলে-কৌশলে মামলাটি উচ্চ আদালতে নিয়ে যায়। সেখানে কোয়াশম্যান্টের আবেদন করায় হাইকোর্ট মামলার নথি তলব ও বিচার কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করে। কিন্তু এত বছর পরও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় মামলাটির শুনানির উদ্যোগ গ্রহণ না করায় বিচার কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। তিনি দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করার জন্য দাবি জানান।

অপরদিকে মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর হোসেন তুহিন জানান, ৬ বাসযাত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার মতো মামলাও যদি আইনের মারপ্যাঁচে আটকে যায় তাহলে এ দায় কার? তিনি দ্রুত মামলাটির বিচারকাজ শেষ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

Source link

Related posts

মাসে ৫ লাখ টাকার ডিম বিক্রি করেন মাহাবুব

News Desk

উন্নত জাতের আমে ঝুঁকছেন রাজশাহীর চাষিরা

News Desk

সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথের প্রেস যাচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে

News Desk

Leave a Comment