সাত দিনের কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় যে যেভাবে পারছেন রাজধানী ছাড়ছেন। সকাল থেকেই রাজধানীর সকল বাস টার্মিনাল ও ফেরিঘাটে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড় দেখা গেছে। অনেকটা ক্ষোভ ও আতঙ্ক থাকলেও তাদের কেউই মানেননি করোনার স্বাস্থ্যবিধি।
দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় ঝুঁকি নিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক, পিকাপ ও মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে ছোটেন গন্তব্যে। তারা বলছেন, গত বছর লকডাউনের পর জীবন-জীবিকার তাগিদে কয়েক মাস আগে ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় তাদের কর্মজীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তাই আবার ফিরে যাচ্ছেন নিজ গ্রামে। তবে এরা পদে পদে পড়েন ভোগান্তিতে। বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন। যারা পরিবহন পাননি না, তারা পায়ে হেঁটেই যাত্রা শুরু করেন।
সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে মানুষের হাঁকডাক জটলা দেখলে মনে হয় ঈদের ছুটিতে তাদের বাড়ি ফেরার তাড়া। শত শত মানুষের ভিড়। এদের কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশাচালক, আবার কেউ নির্মাণশ্রমিক। প্রায় সবার গন্তব্য উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ, তাই শেষ ভরসা পণ্যবাহী ট্রাক। এদিকে ট্রাকচালকরাও সুযোগ বুঝে চড়া দাম হাঁকেন। আবার অনেককেই মোটরসাইকেল বা অটোরিকশায় ভেঙে ভেঙে গ্রামে যেতে দেখা গেছে। এদিকে বাস টার্মিনালে মেলে ভাড়ায় মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার। সাভার, নবীনগর, গাজীপুর এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গতকাল সকাল থেকেই দেখা যায় বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ। বিকল্প যানের চাপে সৃষ্ট যানজট নিরসনে হিমশিম খায় ট্রাফিক পুলিশ।
ঘর ফেরা মানুষরা জানান, গত বছর লকডাউনে কর্মহীন হয়ে গ্রামে চলে যান। মাত্র দুই-তিন মাস আগে জীবন-জীবিকার জন্য ঢাকায় ফিরেছিলেন। এখন আবার লকডাউন থেকে কঠোর লকডাউনে ষোষণা দেয় সরকার। তাই আবার ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয় নতুন দুর্ভোগ। এখন ট্রাক দিয়ে যাচ্ছেন, তাও দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
আমাদের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল থেকেই মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়াঘাটে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিমুলিয়া ঘাটে ৭ শতাধিক যানবাহন আটকে থাকতে দেখা গেছে। পদ্মার শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে কয়েকদিন যাবৎ লঞ্চ যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী স্পিডবোট বন্ধ থাকার কথা থাকলেও শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে স্পিডবোট চলতে দেখা গেছে। অধিকাংশ যাত্রী ট্রলারযোগে ঘাট পার হন।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় রাজধানী ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। এতে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাগামী মানুষের চাপ বেড়েছে। গতকাল সকাল থেকে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসের অতিরিক্ত চাপে ফেরি পারাপারে হিমশিমে খায় ঘাট কর্তৃপক্ষ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোট-বড় ১৪টি ফেরি দিয়ে এসব ছোট গাড়ি পারাপার করা হয়। দুপুরে প্রায় তিনশ পণ্যবোঝাই ট্রাক পার হওয়ার অপেক্ষায় আটকে থাকতে দেখা গেছে। ট্রাক ও পিকাপে চরে যাওয়া যাত্রীরা জানান, কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় গ্রামে ফিরতে মহাসড়ক ও ফেরিঘাটে ভোগান্তিতে পড়েন তারা।
গাজীপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মাগুরার সেলিম খান। জরুরি প্রয়োজনে তিনি সকালে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে করে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত এসে পৌঁছান। ঘাটে থাকা ছোট একটি ফেরিতে তিনি উঠে পড়েন। তার সঙ্গে আরো একজন রয়েছেন। তিনিও বাড়ি যাচ্ছেন।
ক্ষোভের সঙ্গে তারা দুজন বলেন, আমাদের একটি টাকা আয় বাড়েনি। সরকার লকডাউনের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী বহনের কথা বলে ভাড়া বাড়িয়েছে ৬০ শতাংশ। অথচ এই সুযোগে ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ আদায় করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মোটেই মানা হচ্ছে না। বরং করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়ছে।
পাটুরিয়ায় ফেরিতে করে লোকজন পারাপার হন। এতে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা হয়। লোকজন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে যান। তাদের মধ্যে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকেনি। ওই ফেরির যাত্রী কামরুল আহসান ঢাকায় হকারি করেন। তিনি বলেন, গত লকডাউনে ব্যবসাবাণিজ্য প্রায় শেষ, গ্রামে চলে গেছিলাম। গত জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসে কিছু মালামাল এনে ব্যবসা শুরু করি। ঘুরে না দাঁড়াতেই আবার লকডাউন দিয়ে দিল। ব্যবসা করতে পারব না। ঢাকায় থাকলে পুঁজি ভেঙে খেতে হবে। তাই গ্রামে যাচ্ছি।
তবে এভাবে ফেরিতে স্বাস্থ্যবিধি না মানার ব্যাপারে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, কী হবে এ স্বাস্থ্যবিধি মেনে। এতে যদি কাজ হতো তাইলে বড় বড় মানুষ করোনায় মরত না। তবে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সরকারি নির্দেশনা তিনি মেনে চলার কথা জানান।
মানিকগঞ্জ থেকে মোটরসাইকেলে করে কুষ্টিয়ায় যাচ্ছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণের হার প্রতিদিন বাড়ছে। অথচ সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গণপরিবহন না পেয়েও নিজ মোটরসাইকেলে করে রওনা হয়েছি। কিন্তু ফেরিতে উঠে দেখি বেহাল অবস্থা। কোথাও স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানোর জায়গা নেই।
গাবতলী বাস টর্মিনালে গাইবান্ধাগামী আমজাদ হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন দিয়েছে সরকার। আমরা প্রতিদিন কামাই করা মানুষ। এমনিতেই গত এক বছর যাবৎ তেমন কাজকর্ম নাই। সপ্তাহে দুই-তিন দিন কাজ করে অনেক কষ্টে সংসার চালাই। লকডাউনে না পাব কাজ, না পাব খাদ্য বা অর্থ সাহায্য। আমরা কী করে চলব, সরকার আমাদের কথা না ভেবেই লকডাউন দিল। ঢাকা বসে না খেয়ে মরার চেয়ে গ্রামে যাওয়া ভালো, তাই গ্রামে ফিরছি।
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামী ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, এবারে দেওয়া বিধিনিষেধগুলো যাতে সকলে যথাযথভাবে পালন করেন সেজন্য মাঠ প্রশাসনকে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সকলকে তিনি স্বাস্থ্যবিধি মানার অনুরোধ জানান।