অগ্নিঝুঁকিতে চট্টগ্রামের শতাধিক মার্কেট-বাজার-বস্তি
বাংলাদেশ

অগ্নিঝুঁকিতে চট্টগ্রামের শতাধিক মার্কেট-বাজার-বস্তি

চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন রিয়াজুদ্দিন বাজারের রিজওয়ান কমপ্লেক্স মার্কেট। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) মার্কেটটির দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগে। এসময় প্রচণ্ড ধোঁয়ায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান তিন জন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মার্কেটটিতে অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল না। যে কারণে ছোট আগুনেও তিন জন নিহত এবং দুজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামে গত দুই বছরে মার্কেট, বাজার ও বস্তিতে একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহতের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি।

এর আগে, ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় সমবায় মার্কেটে আগুনে একজন নিহত হন। ওই বছরেরই ১২ জানুয়ারি রিয়াজুদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটে, ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রিয়াজুদ্দিন বাজারের হোটেল সফিনায়, ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট চৌধুরী প্লাজায় ও ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর জহুর হকার্স মার্কেটে আগুন লাগে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ৪৫ মার্কেট, ১০টি বাজার, ১২টি বস্তি এবং ৯০ শতাংশ ভবন রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। এসব মার্কেট, বস্তি ও বহুতল ভবনে নেই প্রয়োজনীয় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। চট্টগ্রামে প্রতি বছরই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঘটছে একাধিক হতাহতের ঘটনা। বারবার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দিয়েও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা যাচ্ছে না।

সংস্থাটি জানিয়েছে, গত বছর ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ৬৭৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ১৭ জন, আহত হয়েছেন ৪৫ জন। আগুনে আনুমানিক ১৭ কোটি ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ১৮৫ কোটি ৬৯ লাখ ৫ হাজার টাকার।  

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিয়াজুদ্দিন বাজারে ছোট আগুনে হতাহতের ঘটনা বেশি হয়েছে। আগুন বড় হলে হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতি আরও অনেক বেড়ে যেতো। মার্কেটগুলোতে ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। এমনকি সড়কগুলো এত ছোট যেগুলো দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। মার্কেটগুলো যাতে অগ্নিনির্বাপণের আওতায় আনা হয় এজন্য বার বার কর্মকর্তাদের তাগাদা দেওয়া হয়। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকায় যেসব মার্কেট, বাজার, বস্তি এবং ভবন আছে সবগুলোর কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে তাগাদা এবং সতর্ক করা হয়। এরপরও ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীন সংশ্লিষ্টরা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ বিশেষ করে কোথাও আগুন লাগলে তা নেভানো। যেসব প্রতিষ্ঠান এসব মার্কেটের অনুমোদন এবং তদারকি করেন সেসব প্রতিষ্ঠানের অভিযান চালানো প্রয়োজন, একইসঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাও দরকার।’

ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় অগ্নিঝুঁকিতে থাকা মার্কেটগুলোর মধ্যে একটি রিয়াজুদ্দিন বাজার। যেখানে একসঙ্গে ১০ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে, খাতুনগঞ্জ, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুমন্ডি লেন, গোলাম রসুল মার্কেট, বাগদাদ ইলেকট্রিক সুপার মার্কেট, হাজি সরু মিয়া মার্কেট, নুপুর মার্কেট, সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড় পুল বাজার, ইসা মিস্ত্রি মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্লাতলী বাজার, অধীন চৌধুরী মার্কেট, মহাজন টাওয়ার, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিংমল, গুলজার মার্কেট, আলী মার্কেট, মতি টাওয়ার, শাহেন শাহ মার্কেট, হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার সাপার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলির হাট মার্কেট, ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, মিয়া খান পুরোনো জুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, শেখ ফরিদ মার্কেট, যমুনা সুপার মার্কেট, ষোলশহর সুপার মার্কেট, ইমাম শপিং কমপ্লেক্স ও চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স অন্যতম।

অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা বস্তিগুলো হলো, ঝাউতলা, আমবাগান, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, কলসি দিঘির পাড় কলোনি, আকমল আলী কলোনি, লামার বাজার এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ে বস্তি, অক্সিজেন এলাকার রেলওয়ে বস্তি, বার্মা কলোনি, দুই নম্বর গেট ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ে বস্তি।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৩ লাখ ভবন আছে। যার মধ্যে বহুতল ভবন আছে ৭ হাজার। যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই অগ্নিঝুঁকিতে। অপরদিকে ফায়ার সার্ভিসের ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক জরিপে বলা হয় চট্টগ্রাম মহানগরীতে বহুতল ভবন আছে ১৮ হাজার ৫০০টি। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে আছে ৩ হাজার ১০০টি ভবন। এরমধ্যে অতি অগ্নিঝুঁকিতে আছে ১ হাজার ৭৫০টি ভবন। সাধারণ ঝুঁকিতে আছে ১ হাজার ৩৫০টি ভবন।  

এদিকে, জেলা চট্টগ্রাম প্রশাসকের উদ্যোগে গেলো বছর বিভিন্ন মার্কেটের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ১১টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রতিটি দোকানের ফায়ার লাইসেন্সসহ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে, প্রতিটি মার্কেট সমিতিকে অগ্নিনির্বাপণসহ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজস্ব প্ল্যান থাকতে হবে, মার্কেট সমিতি বিভিন্ন পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে। এসব সিসি ক্যামেরা নজরদারির জন্য ৩-৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে, ডিশ ও ইন্টারনেট লাইন আন্ডারগ্রাউন্ডে নেওয়ার জন্য মার্কেট সমিতি কর্তৃক ডিশ ও ইন্টারনেট মালিকদের অনুরোধ করবেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন মার্কেটসহ, সিটি করপোরেশন, সিডিএ-এর নিয়ন্ত্রণাধীন মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ী সমিতি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

এছাড়াও মার্কেটে রিজার্ভ টাংকি, গাড়ি পার্কিং এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, প্রতিটি বাজার ব্যবসায়ী সমিতি তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্ব-স্ব বাজারে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরও বলা হয়, তারা মার্কেট বা বাজার পরিদর্শন করে স্ব-স্ব বাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিকে নিরাপত্তার তথ্য জানাবেন, ফুটপাত অবমুক্ত করার জন্য সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হবে, বৈদ্যুতিক লাইনের তার বর্তমান সময় উপযোগী করার জন্য বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে চিঠি দেওয়া, জহুর হকার্স মার্কেট দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে হওয়ায় ওই দুটি পাহাড় থেকে বড় বড়  ট্যাংক বসানোর জন্য মার্কেট প্রতিনিধি নিজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে, মহানগর এলাকায় পুকুরগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে সেগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে চারদিকে হাঁটার ব্যবস্থা করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের সবকটি মার্কেট, বাজার, বস্তি পরিদর্শন করা হয়েছে। এসবের কোথায় কী ধরনের ত্রুটি কিংবা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি রয়েছে তা আমরা নোট করেছি। চট্টগ্রামের ৪৫ মার্কেট, ১০টি বাজার, ১২টি বস্তি অনেক বেশি অগ্নিঝুঁকির মধ্যে আছে।’

বিশিষ্ট নগরপরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৯৫ থেকে ৯৬ শতাংশ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে আছে। রিয়াজুদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকুমন্ডি লেইনসহ আরো অনেক মার্কেট আছে অনেক বেশি অগ্নিঝুঁকিতে। ছোট আগুনে তিনটি প্রাণ ঝড়েছে। বড় আগুন হলে হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হতো। তাই চট্টগ্রামের সবকটি মার্কেট, ভবন, বাজার, বস্তি ফায়ার সেপটির আওতায় আনতে জরিমানা কোন স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এজন্য চসিক, সিডিএ, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাকে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে যেসব প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সেফটি নেই; সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ কিংবা সিলগালা করা যেতে পারে।’

Source link

Related posts

খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল

News Desk

সংকটে গমের মজুত কত, লাভবান কারা

News Desk

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মৎস্য ঘেরে বাস, নিহত ১

News Desk

Leave a Comment