বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। একের পর এক বাতিল হচ্ছে পর্যটকদের ভ্রমণের বুকিং। বছরের এই সময়ে পর্যটন নগরীর হোটেল-রিসোর্টে প্রচুর পর্যটক থাকলেও গত দুই সপ্তাহ প্রায় ফাঁকাই ছিল জেলার পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউস। এ অবস্থায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে বলে জানালেন পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা অবরোধের কারণে পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছেন তারা। বছরের এই সময়ে কক্সবাজারে ভিড় করেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। কিন্তু অবরোধের কারণে চলতি মাসের শুরু থেকে সব বুকিং বাতিল করেছেন তারা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসার পথে গণপরিবহন না পাওয়া ও রাস্তাঘাটে সংঘাত, সংঘর্ষের কথা চিন্তা করে বের হচ্ছেন না ভ্রমণপিপাসুরা। ফলে মৌসুমের শুরুতেই পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
হোটেল-রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্টের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউসের বেশিরভাগ এখন ফাঁকা পড়ে আছে। করোনার পর টানা অবরোধের কারণে আবারও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। একের পর শিডিউল বাতিল হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুম শুরু হয় অক্টোবর মাসে। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত থাকে সরগরম। এবার মৌসুমের শুরুতেই রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ফলে আশানুরূপ পর্যটক আসেননি। নভেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহ প্রায় ফাঁকা ছিল সব হোটেল-মোটেল। অবরোধের কারণে বুকিং বাতিল করেছেন সবাই। ফলে ব্যবসায় বড় ধাক্কা খেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এভাবে চলতে থাকলে পুরো মৌসুম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা।
শহরের সমিতিপাড়া এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন মোজাম্মেল হক। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে বিচবাইক চালিয়ে সংসার চালান। তার উপার্জনে চলে বৃদ্ধ মা-বাবা, দুই বোন ও এক ভাইয়ের ভরণপোষণ। সৈকতে পর্যটক বেশি এলে আয় বাড়ে, পর্যটক কমলে কমে যায়। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। হরতাল-অবরোধের কারণে কমেছে পর্যটক। এখন মোজাম্মেলের আয়শূন্য। পরিবারে চলছে নীরব হাহাকার।
মোজাম্মেল বলেন, ‘করোনা মহামারির সময়ে যখন সৈকতে পর্যটক আসা কমে গিয়েছিল, তখনও কোনোরকম সংসার চালিয়েছি। কিন্তু চলতি মাসে বিএনপির হরতাল-অবরোধ অব্যাহত থাকায় ভাটা পড়েছে ব্যবসায়। কমে গেছে দৈনিক আয়। সংসার চলছে ধারদেনা করে কোনোমতে।’
শুধু মোজাম্মেল নন, তার মতো দুই শতাধিক বিচবাইকার রয়েছেন সৈকতে। তাদের প্রত্যেকের সংসার চলছে কোনোমতে। বিকল্প রোজগারের উপায় খুঁজছেন অনেকে।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টে কথা হয় সাইফুল আলমের সঙ্গে। পর্যটকদের ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে সংসার। অবরোধে কমেছে আয়। গত কয়েকদিন ধরে যা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে মালিকের ভাড়া এবং ঘোড়ার খাদ্যের জোগান দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে তারও সংসার চলছে ধারদেনা করে।
সাইফুল বলেন, ‘টানা হরতাল-অবরোধের কারণে কক্সবাজারে পর্যটক নেই। এতে আয় কমে গেছে। দৈনিক যায় আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে পারছি না। ধার করে চলতে হচ্ছে।’
সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, সমুদ্রসৈকতে তেমন পর্যটক নেই। পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা সব আয়োজন করে রেখেছেন। তারা আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। পর্যটক না থাকায় বিচবাইক, ঘোড়া, ফটোগ্রাফার, জেটস্কি ও ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন।
হরতাল-অবরোধের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন হোটেল-মোটেল মালিকরাও। এ অবস্থায় চলতি মৌসুমে পর্যটন ব্যবসায় ধসের আশঙ্কা করছেন তারা।
একাধিক হোটেল-মোটেল মালিক জানিয়েছেন, অক্টোবরের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন কক্সবাজারের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলের ৫০-৬০ শতাংশ কক্ষ বুকিং থাকতো। দিনে অর্ধলক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম হতো। শুক্র ও শনিবারসহ সরকারি ছুটির দিনগুলোতে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যেতো। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা নেমে এসেছে ১০ হাজারে। যারা আসছেন তাদের মধ্যে আবার স্থানীয়দের সংখ্যা বেশি। অবরোধ উপেক্ষা করে যারা বাইরে থেকে সৈকতে আসছেন, তাদের মধ্যেও বিরাজ করছে আতঙ্ক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পর্যটক জানিয়েছেন, টানা অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করেছেন তারা। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় অনেকে বিমানযোগে ঘুরতে এসেছেন। তবে দুই-একদিনের মধ্যে কক্সবাজার ত্যাগ করবেন। কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তারা।
বিমানে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন সাহেদুল ইসলাম ও আফরোজা আক্তার দম্পতি। তারা জানিয়েছেন, এই ভরা মৌসুমে বিপুল পরিমাণ পর্যটক থাকার কথা ছিল। কিন্তু পর্যটক নেই। ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত ফিরে যাবেন। সৈকতে মানুষজন না থাকায় নিজেদেরই ভয় লাগছে।
টানা হরতাল-অবরোধের কারণে জেলার পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল ফাঁকা বলে জানালেন কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম নেওয়াজ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এককথায় পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। একের পর এক হরতাল-অবরোধে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল ফাঁকা। অথচ প্রতি বছর এই মৌসুমে লাখো পর্যটকে মুখর থাকতো কক্সবাজার। যত দ্রুত সম্ভব হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি বালিত করতে হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি।’
পর্যটকবাহী যানবাহন হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে কলাতলী-মেরিনড্রাইভ সড়ক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মৌখিম খান বলেন, ‘টানা অবরোধে পর্যটন ব্যবসায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হোটেল-মোটেল থেকে শুরু করে সৈকতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে আড়াই লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে অনেকে হোটেল-মোটেল বন্ধ করে দেবে। এতে বেকার হয়ে পড়বে অনেকে। এই খাতকে বাঁচাতে পর্যটকবাহী যানবাহন হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখা দরকার। সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’
গত দুই সপ্তাহ ধরে পর্যটক না আসায় ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত হাজার কোটি টাকা এমনটি জানিয়েছেন কক্সবাজার চেম্বার অব ইন্ড্রাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা। তিনি বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে এমন ধস পর্যটন ব্যবসায় এর আগে নামেনি। এক হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করলে চলতি মৌসুমে বিপর্যয়ে পড়বে পর্যটন খাত, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই।’