যশোর শহরের পুরাতন কসবা ঘোষপাড়া এলাকায় ভৈরব নদের পাড়ে দোতলা বাড়ি ব্যাংকার মাহমুদুজ্জামানের। এই নদে জোয়ারভাটা না চললেও গত বছর প্রথম দফায় বিলীন হয় ঘরের কোলঘেঁষে থাকা বালি-মাটির সঙ্গে গাছগাছালিও। তখন ১৪ ট্রাক বালি এবং বাঁশ পাইলিং করে সে যাত্রা ঠিক করা হয় নদের ধারের জমি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে লাগাতার বৃষ্টিতে এবার সেই বালি মাটিসহ নতুন করে লাগানো গাছপালাও বিলীন হয়ে যায় নদের গর্ভে।
শুধু ব্যাংকার মাহমুদুজ্জামানের একার নয়, ভৈরব নদের এই অংশের বিমানবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার শওকত আলী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আমিরুল হাসান, খুদে ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান, গৃহবধূ সায়েমা রহমান, নরসুন্দর গৌতম রায়, বিপ্লব বিশ্বাসসহ শতাধিক ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের কারও দুই শতাংশ, কারও এক শতাংশ জমি কিংবা জমিসহ ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে পড়েছে ভৈরবের গহ্বরে।
জোয়ার-ভাটাবিহীন এই নদে কেন ভেঙে পড়ছে ঘরবাড়ি, সে বিষয়ে জানিয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। তাদের দাবি, বছর তিন-চার আগে ভৈরব খননের নামে তৎকালীন সরকারি দলের নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্ত এই নদে মেশিন লাগিয়ে অবৈধভাবে হাজার হাজার ট্রাক বালি উত্তোলন করে। সেই সময় তাদের মৌখিকভাবে নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা তাদের সেই অপকর্ম চালিয়ে যায়। যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে নদের পাড়ে থাকা লোকজনকে।
মাহমুদুজ্জামানের স্ত্রী শামীমা জামান বলেন, ‘২০২০ সালে ভৈরব খননের সময় স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী লোক এখানে মেশিন লাগিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে। তাদের অনেকবার আমরা নিষেধ করেছি। কিন্তু তারা আমাদের সাফ জানিয়ে দেয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা এই কাজ করছে। তাদের ঠেকানো যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করেছে আর এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। গত বছর ১৪ ট্রাক বালু এখানে দেওয়া হয় কিন্তু এবার বর্ষায় সেগুলো নদে বিলীন হয়ে গেছে। এবার নতুন করে আবারও চার ট্রাক বালুসহ পাইলিংয়ের কাজ করা হচ্ছে। জানি না রক্ষা করা যাবে কি না। যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি এদিকে নজর না দেয় তাহলে আমাদের মতো অনেকেরই ঘরবাড়ি তলিয়ে যাবে।’
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আমিরুল হাসান বলেন, ‘নদ খননের নামে এই অপকর্ম সাধিত হয়েছে। এখানে আমার পাঁচ শতক জমি ছিল। তার ভেতরে স্থাপনাসহ দুই শতক জমি ভৈরবে বিলীন হয়ে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে নদের ধারে বাঁধ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আমাদের রক্ষা, নইলে যতটুকু আছে তা-ও বিলীন হয়ে যাবে।’
গৃহবধূ সায়েমা রহমান বলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে ৩০ বছর। শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে শুনেছি, এখানে পানিতে উঠলেও নেমে গেছে। কখনও নদের কারণে পাড় ভেঙেছে এমন শুনিনি, দেখিনিও। ক্ষমতাশালী লোকজন এই নদ থেকে বালু উত্তোলন করায় আজকের এই পরিণতি। আমাদের আশপাশে ২৫ থেকে ৩০টি ঘর ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে। এখনও যদি রক্ষা করা না যায়, তাহলে বাদ বাকিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।’
নদীর পাড়ের বাসিন্দা খুদে ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান বলেন, ‘নদের ধারে জায়গার দাম কম বলে কিনেছিলাম। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে আছি। কখনও এমন ভাঙন দেখিনি। এই অঞ্চলের প্রভাবশালী লোকজন ভৈরব থেকে বালু উত্তোলন করায় এই অঞ্চলের শতাধিক ঘরবাড়ি ও জমি বিনষ্ট হয়েছে। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, এই ভাঙন ঠেকাতে এবং আমাদের মতো গরিবদের রক্ষা করতে তারা যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।’
ভৈরবের পাড় ভেঙে শতাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, ‘ভাঙনের কথা শুনে আমি স্টাফসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, কতিপয় দুষ্কৃতকারী নদের ওই অঞ্চল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় সেখানে কিছু ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয়। আমরা সার্ভে করে দেখেছি ওই ভ্যাকুয়ামের কারণেই ভাঙন হচ্ছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে ইতোমধ্যেই তা প্রতিকারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। খুব শিগগিরই প্রতিরক্ষামূলক কাজ শুরু করা হবে, যাতে করে ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বার ক্ষতির সম্মুখীন না হয়।’