চট্টগ্রামে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অনুমোদনহীন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এসব হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে নানা অব্যবস্থাপনাসহ চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছিল। ওই সময় টনক নড়েনি জেলা সিভিল সার্জন কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগের। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর হঠাৎ নড়েচড়ে বসেছেন জেলা সিভিল সার্জন।
শনিবার (২৮ মে) থেকে অনুমোদনহীন অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ। মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দিনে বিভাগে ২১২টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ১৫টি, নগরীতে ১০টি ও উপজেলায় পাঁচটি।
এদিকে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও অবৈধ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না আইনগত ব্যবস্থা। ফলে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন নামে চালু হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে অনুমোদন না নিয়ে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু হয় কীভাবে, সে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকরা। তাদের অভিযোগ, এসব হাসপাতাল মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা করছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ১৫৬টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৯৩টি এবং ১৫ উপজেলায় ৬৩টি। তবে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে অনুমোদনহীন কোনও ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা নেই। অনেক ক্লিনিক কাগজপত্রও নবায়ন করেনি।
স্থানীয়রা বলছেন, অনুমোদন না নিয়ে এতদিন কীভাবে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগ কেন এতদিন অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনুমোদনহীন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের ক্ষমতা জেলা সিভিল সার্জনকে দেওয়া আছে। এমনকি উপজেলা পর্যায়ে অবৈধভাবে হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠলে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি)। তারা তো এতদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত চালাননি। অবৈধ হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে তারা অভিযান চালালে স্বাস্থ্য বিভাগের নতুন করে নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেগুলো বন্ধ করাতো স্বাস্থ্য বিভাগের রুটিন কাজ। কিন্তু কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা ছাড়া কেউ কোনও কাজই করছেন না। সবসময় কর্মকর্তারা দায়িত্ব পাশ কাটানোর চেষ্টা করেন। কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেবে তারপর ব্যবস্থা নেবেন। এটা খুবই দুঃখজনক। এতগুলো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এতদিন চোখ বন্ধ করে রেখেছিল কেন? অনুমোদনহীন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে মানুষ চিকিৎসা নিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর দায়ভার স্বাস্থ্য বিভাগকে নিতে হবে। কারণ তারা অন্যায়কে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত কয়েক দিনের অভিযানে চট্টগ্রাম বিভাগে ২১২টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বন্ধের তালিকায় চট্টগ্রাম জেলায় আছে ১৫টি। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর লাগাম টানার চেষ্টা করছি আমরা।’
বন্ধ করে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন নামে খুলবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ চলে গেছে। সামনে নতুন নামে আসতে পারে তারা। তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। সেগুলো নিয়মিত তদারকি করা হবে।’
অবৈধ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বলেন, ‘সেটা নিয়ে আমরা ভাবছি। প্রাথমিকভাবে বন্ধ এবং সতর্ক করা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে করা ১৯৮২ সালের আইন প্রয়োগের বিষয়ে নানা বিধিনিষেধ আছে। ফলে এই আইনের সংশোধন প্রয়োজন।’ তবে ওই আইনে কি আছে তা উল্লেখ করেননি তিনি।
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগে অভিযানে হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে কি কি সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে এসব সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে।’
চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনায় এ অভিযান চলছে। তবে অনুমোদনহীন চিকিৎসাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে সবসময় অভিযান চলে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে মাঝখানে বন্ধ ছিল। এখন পুনরায় অভিযান শুরু হয়েছে।’
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ম ম মিনহাজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমত পেশাজীবী সংগঠনের নেতা হিসেবে অভিযানকে স্বাগত জানাই। দীর্ঘদিন পর হলেও স্বাস্থ্য বিভাগ এমন উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে বেসরকারি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার দুই ধরনের আছে। এর মধ্যে এক ধরনের আছে, অনুমোদন না নিয়েই চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করা হচ্ছে। অপর ধাপে আছে, যারা অনুমোদন নিয়েছে, কিন্তু কাগজপত্র নবায়ন করেনি।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে অভিযান চালানো প্রয়োজন কোনও প্রকার অনুমোদন না নিয়ে গড়ে ওঠা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তাহলে মানুষ প্রতারণা থেকে রেহাই পাবেন। পাশাপাশি অনুমোদন থাকার পরও যেসব প্রতিষ্ঠান কাগজপত্র নবায়ন করেনি, সেগুলোকে সময় বেঁধে দিয়ে সতর্ক করা প্রয়োজন। তাহলে শৃঙ্খলা ফিরতো চিকিৎসাসেবায়।’
মিনহাজুর রহমান আরও বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় আসছে অভিযানে এতটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে চলছে। এ ধরনের লোক দেখানো অভিযান কোনও কাজে আসবে না। সিভিল সার্জন সরেজমিন গিয়ে বন্ধের নোটিশ দিয়ে আসছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ নির্দেশনা মানছেন না। না মানলে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। চট্টগ্রামে কোথায় অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আছে, তা তদারকির জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মনিটরিং সেল নেই। হাসপাতালের কাগজপত্র নবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরের সনদের জন্য গেলে তারা বলে আগে স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন। স্বাস্থ্য বিভাগের সনদের জন্য গেলে তারা বলে আগে পরিবেশ অধিদফতরের সনদ লাগবে। কে আগে সনদ দেবে, সেটা ঠিক করতে হবে। সনদ দেওয়ার বিষয়টি আরও সহজ করতে হবে।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. দেব প্রসাদ চক্রবর্তী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা অভিযান শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত কোনও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়নি। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চার পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যেগুলোর চিকিৎসার মান নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। এসব ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিযুক্ত দালাল চক্রের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে।
গত মঙ্গলবার (৩১ মে) চমেক হাসপাতালের গাইনি ও স্ত্রী রোগ বিভাগ থেকে রাজিব নামে এক দালালকে আটক করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে তাকে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শামীম আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চমেক থেকে কিছু বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নিতে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। একসময় চমেক হাসপাতাল থেকে দৈনিক ১২০-১২৫ জন করে রোগী ভাগিয়ে নিতো। কড়াকড়ির কারণে অনেক কমেছে। যা বর্তমানে ২০-২৫ জনে নেমেছে। রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার সময় অনেক দালাল হাসপাতাল কর্মকর্তাদের হাতে আটক হয়েছে। তাদের পুলিশে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসাসেবার মান ভালো হলে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। বর্তমানে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। তবে কথা হচ্ছে অনুমোদন না নিয়ে হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠান চালু হয় কীভাবে। এসব হাসপাতাল মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা করছে।’
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অবৈধ মানেই হচ্ছে যার কোনও ভিত্তি নেই। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। তাও আবার অবৈধ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান ঢাকঢোল বাজিয়ে বন্ধ করার প্রয়াজন নেই। অবৈধ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দেওয়া আছে। এতদিন তাদের ইচ্ছার অভাব ছিল। অভিযান-তদারকি নিয়মিত থাকলে আজ চিকিৎসাসেবা নিয়ে ব্যবসা হতো না। অবৈধভাবে কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারতো না।’