আগ্রহভরে পুরোনো একটি পুঁথি হাতে নিয়েছিলেন সংস্কৃতিকর্মী আহসানুল কবীর। পাতাটি গুঁড়া গুঁড়া হয়ে ঝরে যাওয়ায় দ্বিতীয় পুঁথি দেখার সাহস পাননি। নিজের শহরের দুই শ বছর আগের ইতিহাস জানতে তিনি গিয়েছিলেন কুমিল্লার মহেশাঙ্গনের রামমালা পাঠাগারে। এ অঞ্চলের শান্তিনিকেতন হিসেবে পরিচিত এই মহেশাঙ্গনের সাম্প্রতিক গল্প বলতে গেলে অনেকেরই মুখটা মলিন হয়ে যায়। অথচ পেছনে রেখে আসা সময়ের কথা জানতে চাইলেই গল্প অনিঃশেষ।
বই ও পুঁথি নষ্ট হয়ে যাওয়া দেখে বিষাদ নিয়ে ফিরেছিলেন আহসানুল কবীর। এই সংস্কৃতিকর্মী প্রথম আলোকে বললেন, ‘এ অভিজ্ঞতা ২০১৯ সালের। এখন তো বন্ধই পাঠাগার। সমৃদ্ধ সংগ্রহ থাকতেও শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবে পুরোপুরি নষ্ট হতে চলেছে দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য।’
শতবর্ষী এই পাঠাগার পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে চার মাস ধরে। কবে খুলবে, কেউ জানে না। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রয়েছে ট্রাস্টের সদস্য ও জনপ্রতিনিধির। তবে এসব তর্কবিতর্কের মধ্যে সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে অমূল্য সম্পদ। আধুনিকায়নের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এত বছরেও। এসব নিয়ে আছে নানা বাদানুবাদ।
আয় নেই দাবি ট্রাস্টের, অভিযোগ অবহেলার
কুমিল্লার রামমালা পাঠাগারটি চলে মহেশাঙ্গন ট্রাস্টের সিদ্ধান্তে। মহেশাঙ্গনে রামমালা পাঠাগার ছাড়াও আছে নিবেদিতা বিদ্যালয়, ঈশ্বর পাঠশালা ও ছাত্রাবাস। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে প্রধান হয়েছে রামমালা পাঠাগারের পরিচিতি। মহেশাঙ্গন ট্রাস্টের বর্তমান কমিটি গঠন হয়েছে বছর দুয়েক আগে। সংগ্রহ সংরক্ষণ আর পাঠাগারটি সচল রাখার বিষয়ে গত দুই বছরেও ট্রাস্টের কোনো বৈঠক হয়নি। এই কমিটি কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গঠন হয় না বলে দাপ্তরিকভাবে জবাবিদিহির বাধ্যবাধকতাও নেই সদস্যদের।
ট্রাস্টের প্রধান আইনজীবী নিখিলেশ দত্ত অসুস্থতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে আছেন। এসব প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছিল কমিটির আরেক সদস্য আইনজীবী স্বরূপ দেবের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘ট্রাস্টের চুক্তির মধ্যে অনেক ঝামেলা আছে। চাইলেই আমরা বাইরে থেকে কোনো সহযোগিতা নিতে পারি না। সরকারি অনুদান নেওয়ারও সুযোগ নেই। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের আয় নেই, লোকবল নেই। এটা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান না যে একা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। অথচ এটা লাভজনক প্রতিষ্ঠানও না।’
তবে ট্রাস্টের অবস্থা যেমনই হোক, সন্দেহ নেই রামমালা পাঠাগারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির দখল নিতেই আগ্রহী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তালাবদ্ধ অবস্থায় এই পাঠাগারে নষ্ট হচ্ছে এমন সব বই, যেগুলো আর কখনোই সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। দীর্ঘ সময় ধরে পাঠাগার বন্ধ থাকার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছে। কুমিল্লা–৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন প্রথম আলোকে বললেন, ‘ট্রাস্ট কাজ করলে এত বড় প্রতিষ্ঠান এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা নয়। এটা শুধু আজকের ঘটনা না, অনেক দিন ধরেই তারা কোনো কাজ করে না। অথচ এখানে বিশাল সম্পত্তি আছে। ট্রাস্টি বোর্ড চালায় বলে সরকার কোনো সিদ্ধান্তও দিতে পারে না। ট্রাস্টের ঝামেলায় নষ্ট হচ্ছে রামমালা পাঠাগার।’
নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ১৯৮২ সালে পণ্ডিত প্রবর রাসমোহন চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর থেকেই। তাঁর মৃত্যুতে সরে যায় রামমালার মাথার ওপরে থাকা ৫৬ বছরের বটবৃক্ষের ছায়া। রাসমোহন চক্রবর্তী এই পাঠাগারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৯২৬ সালে। এরপর একার পক্ষে যতটুকু সম্ভব আগলে রাখতে চেষ্টা করেছেন সহকারী গ্রন্থাগারিক ইন্দ্র কুমার সিংহ।
রাসমোহন চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর এখানে নতুন বই কবে কেনা হয়েছে, জানেন না ট্রাস্টের সদস্যরা। কেউ বই দিলে জমা হয়েছে সংগ্রহের খাতায়। মাত্র হাজার তিনেক টাকা সম্মানী পাওয়া ইন্দ্র কুমার সিংহের একার পক্ষে বই, পুঁথি শুধু আগলে রাখাই সম্ভব ছিল। সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে না ছিল তাঁর অধিকার, না ক্ষমতা। তবে তিনি থাকতে তা–ও পাঠক এই অমূল্য ভান্ডার থেকে বই খুঁজে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। একটা নির্দিষ্ট সময়ে পাঠাগারে পড়ার সুযোগও ছিল। তাঁর বয়সের সঙ্গে বেড়েছে পাঠাগার ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা। গত ২৪ জুন ইন্দ্র কুমার সিংহের মৃত্যুর পর থেকে পুরোপুরি বন্ধ রামমালা পাঠাগার। অর্থাৎ এখানকার দুষ্প্রাপ্য বই ও প্রায় সাড়ে আট হাজার পুঁথি তালাবদ্ধ চার মাস ধরে।
পাঠাগারের বন্ধ দরজা থেকে পাঠক ফিরে আসার ঘটনা ঘটছে। তবে ট্রাস্টের সদস্য অনিল সরকার এটি পুরোপুরি বন্ধ নয় বলে দাবি করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দেখাশোনার লোক নেই। তাই তালা দিয়ে রাখা হয়। যে কেউ এলে খুলে দেখানোর ব্যবস্থা হয়। মূল্যবান বই চুরি হলে এর দায় কে নেবে?’ পাঠাগার দেখার চেয়েও ব্যবহারের প্রয়োজন বেশি। ঢাকায় একটি অনলাইন সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিক রাজীব নূর প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘রামমালা পাঠাগারের দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ দেখতে গিয়ে বিফল হয়েছি। এ বছরের জুন-জুলাই মাসে তিনবার চেষ্টা করেছি ভেতরে যেতে। দেখার সুযোগ পাইনি।’
তালাবদ্ধ ঘরের ভেতর ভ্যাপসা বাতাসে নষ্ট হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী অনেক সংগ্রহ। অথচ দিনের পর দিন এই সব সংগ্রহ সমৃদ্ধ হয়েছে রাসমোহন চক্রবর্তীর অক্লান্ত প্রয়াস আর ইন্দ্র কুমার সিংহের আন্তরিকতায়।
রাসমোহন চক্রবর্তী স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে চেয়ে আনতেন বইপত্র, পুঁথি। একসময়ের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বর্তমান কুমিল্লার বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে এসে পৌঁছে দিতেন তাঁদের কাছে থাকা মূল্যবান পুঁথিটি। তাই কুমিল্লার রামমালা পাঠাগার দেশের একমাত্র সামাজিকভাবে তৈরি পুঁথি সংগ্রহশালা।
১৯৯২ সালে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়ির বৈঠকখানায় শুরু হয় একটি সংস্কৃত গ্রন্থাগার। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সে আমলে কেনা হয়েছে ৮১ হাজার টাকার বই। গ্রন্থাগারের সংগ্রহে থাকা আট হাজার পুঁথির ভেতর অধিকাংশ সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এই পাঠাগারে আছে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ বা বাঁধাই করা বিশ্বভারতীর সংখ্যা। আছে ম্যাক্স মুলার সম্পাদিত ‘স্যাক্রেড বুক অব দি ইস্ট’–এর ৫০ খণ্ডের প্রথম সংস্করণ। কনফুসিয়াস থেকে শেক্সপিয়ারের রচনাসমগ্রের সংগ্রহের সঙ্গে জায়গা পেয়েছে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের দুষ্প্রাপ্য কিছু বই। আছে ভূর্জপত্র, কলাপাতা, তালপাতা, তুলটপত্র ও কাঠে খোদাই করা পুঁথি। চিত্র বন্ধ কাব্য পুঁথি (ছবি এঁকে লেখা পুঁথি) সম্ভবত এই একটি সংগ্রহশালায় পাওয়া যাবে বাংলাদেশে। এর মধ্যে আছে ধর্মতত্ত্ব, কাব্য, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি। কিন্তু এর অধিকাংশেরই পাঠোদ্ধারের কোনো চেষ্টা হয়নি। এমনকি সঠিক তালিকাও পাওয়া যায় না।
দীর্ঘদিন ধরে এগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ট্রাস্ট। অনেক সংগ্রহই এর মধ্যে পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। যেগুলো আছে, সেগুলো সংরক্ষণের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে ট্রাস্টের সদস্য স্বরূপ দেব প্রথম আলোকে বললেন, ‘ইচ্ছা থাকলেও এখনই এই পুঁথি ডিজিটাইজ করার সামর্থ্য বা সুযোগ নেই। পুরোনো কর্মচারীদের আন্তরিকতায় যতটুকু সম্ভব চলছে প্রতিষ্ঠান। কমল নামের একজন আছে, যাকে মাঝেমধ্যে গিয়ে বইপত্রগুলো পরিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া আছে।’ সরেজমিনে দেখা গেছে, আদতে এই সামান্য ঝাড়ামোছার কাজটিও অনিয়মিত। দায়িত্বটি যাঁকে মুখে মুখে দেওয়া হয়েছে, তিনি এর জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি নন।
রামমালা পাঠাগারে কিছুদিন গবেষণার কাজ করেছেন লোকশিল্পবিষয়ক গবেষক সাইমন জাকারিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রাসমোহন চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর রামমালায় নতুন কোনো বই কেনা হয়েছে কি না সন্দেহ। অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেও পরে আর সবার জন্য উন্মুক্ত রাখেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অথচ বিপুল এই আয়োজনের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই পাঠাগারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক গুণীজনের স্মৃতি। বিভিন্ন সময়ে যাঁরা এসেছেন এই পাঠাগারে।