ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বারান্দায় ও সিঁড়িতে চিকিৎসা, সরকারি ওষুধ না দেওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো ও চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব কারণে চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে বিপাকে রয়েছেন রোগীরা। এ নিয়ে ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পঞ্চম পর্বে থাকছে সরকারি এই হাসপাতালে ‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের’ কবলে জিম্মি হয়ে রোগীরা কীভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেই চিত্র।
হাসপাতালের সামনে সবসময় সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে অন্তত দুই শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স। রোগী পরিবহনে চাহিদা যতটা, তার চেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু রোগী পেলেই ভাড়া হাঁকা হয় অনেক বেশি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্স না নিয়ে অন্য কোথাও থেকে কম টাকায় ভাড়া করবেন, সে সুযোগ নেই। হাসপাতালকেন্দ্রিক ‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট’ রোগীকে বাইরের অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই দেবে না। তাদের এক কথা, অন্য অ্যাম্বুলেন্স নিতে হলে তাদের টাকা দিতে হবে। দূর থেকে মনে হবে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অ্যাম্বুলেন্সের মতো একটি জরুরি পরিবহনসেবাকে ঘিরে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে মাসের পর মাস। সব জেনেও কোনও ব্যবস্থা নেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা জেলা অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির নেতারা।
১৫ ডিসেম্বর দুপুরে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের আসলাম হোসেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমার ভগ্নিপতি কামরুল ইসলাম পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে সাত দিন ভর্তি থাকার পর চিকিৎসক ১৫ ডিসেম্বর ছাড়পত্র দিয়েছেন। তাকে মোহনগঞ্জে নেওয়ার জন্য হাসপাতালের সামনে থেকে নেত্রকোনার এক চালকের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করি তিন হাজার টাকায়। দুপুরে রোগীকে ওই অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় হাসপাতালের সামনে থাকা অ্যাম্বুলেন্স চালকরা বাধা দেন। তারা রোগীকে তুলতে দেননি। কারণ চালকরা বলেছেন, হাসপাতালের সামনের অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে নিতে হবে। ভাড়া লাগবে সাড়ে চার হাজার টাকা। অন্য স্থানের অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিতে পারবে না।’
আমরা গরিব মানুষ, এত টাকা সঙ্গে ছিল না উল্লেখ করে আসলাম আরও বলেন, ‘এ অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াই রোগীকে অটোরিকশায় করে পাটগোদাম ব্রিজ মোড়ে নিয়ে যাই। ওখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে মোহনগঞ্জে যাই। হাসপাতালের সামনের অ্যাম্বুলেন্স চালকরা রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে রেখেছেন। তাদের ছাড়া অন্য কোনও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা যায় না। এটি মারাত্মক সিন্ডিকেট।’
রোগী, স্বজন, চিকিৎসক-নার্স এবং কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালের প্রাঙ্গণজুড়ে সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স। যে কেউ দূর থেকে দেখলেই বুঝবে এটি অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড। প্রতিদিন জরুরি বিভাগ ও নতুন ভবনের সামনের এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে রাখা হয় দেড় থেকে ২০০ শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স। এর সবগুলো বেসরকারি। এতে রোগী, তাদের স্বজন, চিকিৎসক-নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশেষ করে জরুরি বিভাগের সামনে সারিবদ্ধভাবে এসব গাড়ি রাখায় ঠেলাঠেলি করে রোগীদের ভর্তি হতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। কোনও কোনও রোগী ওয়ার্ডে যাওয়ার আগেই মারা যান, আবার অনেকের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এ নিয়ে হাসপাতালের দায়িত্বশীলরা কোনও পদক্ষেপ নেন না বলে অভিযোগ রোগী ও তাদের স্বজনদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের আর কোনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এভাবে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড গড়ে তোলার নজির আছে কিনা, তা আমার জানা নেই। জরুরি বিভাগ ও আউটডোরের সামনে এলোমেলোভাবে গাড়ি রেখে দেওয়ায় হাসপাতালে ঢোকা যায় না। রোগীসহ সবার ভোগান্তি পোহাতে হয়। একেবারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। সবসময় লেগেই থাকে। হাসপাতালে ঢোকার সময়ে সবাই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। আবার মাঝেমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চালকরা নারীদের নিয়ে নানা ধরনের টিটকারি করে। হাসপাতালের প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড নেই বললেই চলে। চোখের সামনে এভাবে অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড গড়ে উঠলেও এ নিয়ে প্রশাসনের কোনও তৎপরতা চোখে পড়েনি আমার।’
হাসপাতালের কর্মচারী মো. হাসান বলেন, ‘দিনে-রাতে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে দুই শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে রাখায় রোগী নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্স কিংবা অটোরিকশা সহজে ঢুকতে পারে না। এতে রোগী নিয়ে আসা স্বজনরা বিপাকে পড়েন। সময়মতো অনেক রোগীকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে পারেন না তারা। গুরুতর রোগীরা অনেক সময় জরুরি বিভাগের সামনেই মারা যান। অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগী ছাড়াও চিকিৎসক-নার্স এমনকি কর্মচারীরা সহজে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে পারছেন না।’
এসব অ্যাম্বুলেন্সের কারণে জরুরি বিভাগের সামনে ভোগান্তিতে পড়েছেন তারাকান্দা উপজেলার কোদালিয়া গ্রামের আবু সাইদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মায়ের (৬৫) শ্বাসকষ্টসহ হার্টের সমস্যা থাকায় হাসপাতালে ভর্তির জন্য সিএনজি অটোরিকশাযোগে নিয়ে আসি। গ্রামের বাড়ি থেকে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হাসপাতালের মূল গেট দিয়ে ঢোকার পর জরুরি বিভাগের সামনের পুরো এলাকাজুড়ে শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি অটোরিকশাসহ আরও রোগী বহনকারী গাড়ি দেখা যায়। সবগুলো যানবাহন এলোমেলোভাবে রেখে দেওয়ায় কোনোভাবেই মাকে জরুরি বিভাগে নিতে পারছিলাম না। শেষে ঠেলাঠেলি করে ৪০ মিনিটের চেষ্টায় জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। এই সময়ে মায়ের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। জরুরি বিভাগে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দেওয়ার কথা বলেন চিকিৎসক। এরপর সিসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি করি।’
সরকারি হাসপাতাল প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স চালকদের দখলে, এটি রোগীদের ভোগান্তি ছাড়া কিছুই নয় উল্লেখ করে আবু সাইদ আরও বলেন, ‘বিশৃঙ্খলভাবে রাখা এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা হাসপাতালের কোনও সিকিউরিটি গার্ড নেই। প্রশাসন না দেখলে এসব দেখবে কে?।’
একই দুর্ভোগে পড়েছেন মেডিসিন বিভাগের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী আনিসুর রহমানের স্বজন জোবায়েদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগের সামনে গেলেই এই অরাজক পরিস্থিতি চোখে পড়বে সবার। অ্যাম্বুলেন্সগুলো বিশৃঙ্খলভাবে মালিক ও চালকরা ব্যবসা করছেন। আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এটি মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃৃপক্ষের নজরে কেন আসে না, এটা আমি বুঝি না। এতেই বোঝা যায়, হাসপাতালকেন্দ্রিক অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সবাই এ থেকে কমিশন পায়।’
জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে রেখেছেন চালক কামরুল ইসলাম। রোগীদের ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সড়ক থেকে প্রশাসন আমাদের অ্যাম্বুলেন্স উঠিয়ে দেওয়ায় আমরা প্রায় দুই মাস ধরে হাসপাতালের ভেতরে রাখছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখানে অ্যাম্বুলেন্স রাখতে কোনও বাধা দেয়নি। নিষেধও করেনি। নির্ধারিত অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড না থাকায় আমরা কোথায় গাড়ি রাখবো। আমরা রোগীদের সমস্যায় ফেলছি না। রোগীরা চলাচল করতে পারছেন। আমরা কাউকে বাধা দিচ্ছি না।’
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ও ফোকাল পারসন ডা. মাইন উদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধে হাসপাতালের ভেতরে জরুরি বিভাগের সামনে পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স ও দুটি লাশ বহনকারী যানবাহন রাখার অনুমতি দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চালকরা এই নির্দেশনা না মেনে ইচ্ছেমতো অ্যাম্বুলেন্স রাখছে। এতে রোগী, চিকিৎসক-নার্স ও কর্মচারীদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে আমাদের।’
‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের’ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি মো. সেলিম মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চালকদের কাছে আমরা মালিকরাও জিম্মি হয়ে পড়েছি। তবে এ ধরনের অভিযোগ রোগী ও স্বজনরা কখনও আমাদের কাছে করেননি। অভিযোগ পেলে চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চালকদের বলা আছে, যেকোনো রোগী কিংবা তার স্বজন যেকোনো অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে পারবে। তাদের বাধা দেওয়া যাবে না। তবে কিছু চালক আছে খারাপ প্রকৃতির। তাদের কারণে আমাদের সবার দুর্নাম হচ্ছে।’