টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে আবারও ডুবেছে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল। জেলার সুরমা, যাদুকাটা, রক্তি, চলতি, বৌলাই, পুরাতন সুরমা, খাসিয়ামারাসহ সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। এতে হাওর এবং খাল-বিলের পানি উপচে সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার বাড়ি-ঘরে পানি ঢুকেছে। সড়ক ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, ১৫ দিনের ব্যবধানে ফের বন্যার পানিতে সব তলিয়ে যাওয়ায় এখন পরিস্থিতি বেশ নাজুক হয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি, রক্তি ও যাদুকাটা নদীতে পানি বাড়ায় খরচার হাওরের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা কমপ্লেক্স, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পুরান বাজারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। উপজেলা কমপ্লেক্স হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে আসা লোকজন পানি মাড়িয়ে অফিসে গিয়ে কাজ করছেন।
এদিকে মুক্তিরখলা গ্রামের সড়ক, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। হঠাৎ আসা পানিতে উপজেলার ফতেহপুর ও দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
মুক্তিরখলা গ্রামের ইদ্রিস আলী বলেন, ‘১৫ দিনের মধ্য দুইবার বন্যা আইছে। সকাল থেকে গ্রামের রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।’
কৃষ্ণপুর গ্রামের কাঞ্চন বিশ্বাস বলেন, ‘গ্রামের রাস্তাঘাটে হাঁটুপানি, চলাচল করা যায় না। কয়দিন আগে একবার পানি হইছে এখন আবার পানি আইছে। এত বন্যা হইলে মানুষ বাঁচবো কেমনে।’
হাওরের পানি বেড়ে নিচু এলাকার ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে। কৃষকরা গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মে মাসের ১৫ তারিখ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ।
তাহিরপুর উপজেলার বালিজুড়ি ইউনিয়নের বালিজুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামুল হক বলেন, ‘গত দুই দিনের বৃষ্টিপাতে হাওরসহ সব জায়গায় পানি বেড়েছে। সকালে বিদ্যালয়ে এসে দেখি শ্রেণিকক্ষে হাঁটুপানি। শিক্ষার্থীরা পানির ভেতরে ক্লাস করতে পারবে না। তাই আমরা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছি। এছাড়া তাহিরপুর উপজেলার বালিজুড়ি ইউনিয়নের আনোয়ারপুর বাজারেও পানি উঠেছে। বাজারের মসজিদের ভেতর পানি প্রবেশ করার ফলে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ে বিঘ্ন ঘটছে।
এদিকে আগামী কয়েক দিন সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টিপাত হবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, আগামী ১০ দিন সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত হবে। জুন মাসে ১৫ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত ভারী বৃষ্টি হতে পারে। জুন মাসে প্রতিদিনই কম-বেশি বৃষ্টি হবে। তবে ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর এবং সদর উপজেলায় বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, জুন মাসজুড়ে সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হবে। উজানে বৃষ্টিপাত কম হলেও সুনামগঞ্জে প্রতিদিন বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এমনিতেই জেলার নদ-নদী ও হাওর পানিতে ভরপুর রয়েছে। এর ওপর ভারী বৃষ্টিপাতে আবারও বন্যা দেখা দেবে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এলাকায় খাসিয়ামারা নদীর পানি প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত করেছে। পানির কারণে রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। উপজেলার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিউর রহিম জাদিদ বলেন, পাহাড়ি ঢলে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘পাহাড়ি ঢলের পানি ক্রমেই বাড়ছে। ইতোমধ্যে এই উপজেলার আনোয়াপুর বাজার এলাকার সড়ক প্লাবিত হয়েছে। আমরা বন্যার্তদের সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
তবে বন্যায় কৃষির অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে জানিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, আবার পানি বাড়ায় আউশ ধানের ক্ষতি হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে সব ইউএনও-কে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক সহায়তা হিসেবে চাল, শুকনো খাবার বিতরণ করার নির্দেশরা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (১৪ জুন) জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সভা আহ্বান করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে ২২০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।