ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার আদায়ে ভূমিকা রাখতে থাকে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে নাম ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে এদেশের মানুষকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। নানা লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ ১০০ বছর পূর্তি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের মানুষের সকল ঐতিহাসিক আন্দোলন ও বিজয়ের হৃদপিণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি দেশের মানুষের প্রয়োজনে বুক চেতিয়ে লড়াই করেছে। রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। বিজয় এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষকে লড়াই করে অধিকার আদায়ের শিক্ষা দিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালি জাতির এমন কোনো অর্জন নেই যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান নেই। বলা হয়, এ জাতির যা কিছু মহৎ, যা কিছু উত্তম তা সবকিছুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
একশ বছর আগে ১৯২১ সালের এই দিনে পূর্ব বাংলার প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি’ করতে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে- শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশ উন্নয়ন এবং গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন, মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প এবং মৌলিক গ্রন্থ রচনাসহ জার্নালসমূহ আধুনিকায়ন ও শতবর্ষের উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ, প্রয়াত অধ্যাপক ড. রতন লাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘হিস্ট্রি অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ এবং এমিরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘দ্যা রোল অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ইন মেকিং অ্যান্ড সেপিং বাংলাদেশ’ নামক দুটি গ্রন্থ প্রণয়ন এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সংযোজনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারসমূহ আধুনিকায়ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এই জাতির যা কিছু মহৎ, যা কিছু উত্তম তার সবকিছুর পেছনের যে ভূমিকা তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনে, জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক মূলবোধের বিকাশে সর্বোপরি একটি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক গণতান্ত্রিক এই সকল মূল্যবোধের লালনকেন্দ্রের উৎপত্তিস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এটিকে আবর্তন করেই জাতির সকল বৃহত্তর অর্জনসমূহ, সকল উন্নয়নের একটি শক্তিশালী নিয়ামক ও অনুঘটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের সবই ইতিহাস এক সূত্রে গাথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দেশের, এই ভূখণ্ডের মানুষের উচ্চশিক্ষার পথটি সুগম করে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণ উজ্জ্বল থাকবে। আর একই সাথে উচ্চশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এই দেশের মানুষের সচেতন করার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম সর্বক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো অনাগত ভবিষ্যতে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবেন বা শিক্ষকতায় আসবেন সেগুলো তাদের জন্য সবসময় অনুপ্রেরণার অংশ হয়ে থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯১২ সালের ২৭ মে গঠিত হয় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট নাথান কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয় নাথান কমিশনের ওপর। ১৯১৩ সালে নাথান কমিশনের ইতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই রিপোর্টটি অনুমোদিত হয়। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হয়। কিন্তু এর পরবর্তী বছরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের পথে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ালেও সব প্রতিকূলতার মধ্যেও নাগরিক সমাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। ১৯১৭ সালে স্যাডলার কমিশন ইতিবাচক রিপোর্ট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ধাপ তৈরি হয়।
অবশেষে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯২০’ পাস হয়। ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এই বিলে সম্মতি প্রদান করেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সব সন্দেহের অবকাশ ঘটে। এই আইনকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইনটির বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’।
প্রতিষ্ঠায় অবদান যাদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন স্যার নবাব সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করেন ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি আর কুলচার, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দচন্দ্র রায় প্রমুখ। সেইসময় ১৯১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া বিলের জন্য নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে একমাত্র বাঙালি মুসলমান সদস্য হিসেবে ছিলেন খানবাহাদুর আহছানউল্লা। ১৯১৭ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর নবাব সৈয়দ শামসুল হুদাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য ঘোষণা করা হয়।
শতবর্ষ উপলক্ষে কর্মসূচি
শতবর্ষের মূল অনুষ্ঠান বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমক পূর্ণভাবে ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাসের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক্ষেত্রে স্বল্প পরিসরে আজ ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনায় দিবসটি উপলক্ষে ক্যাম্পাসে সশরীরে কোনো অনুষ্ঠান হবে না, তবে অনলাইনে প্রতীকী কর্মসূচি হবে। অনলাইনে প্রতীকী কর্মসূচির অংশ হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে এদিন বিকেল চারটায় এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে মূল বক্তা হিসেবে থাকবেন ভাষাসৈনিক, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ: ফিরে দেখা’ শীর্ষক মূল বক্তব্য প্রদান করবেন।