সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনছেন খুলনা অঞ্চলের চাষিরা। লবণাক্ত পানি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং রোগ-বালাইসহ নানা কারণে চিংড়ির পোনা মারা যাওয়ায় ক্রমাগত আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা। তবে এ পরিস্থিতিতে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে দ্বিগুণ উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা।
সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় খুলনার পাঁচ জেলায় সাত হাজার চাষিকে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৯০টি ক্লাস্টারের (প্রতিটি ক্লাস্টারে ২৫টি ঘের) দুই হাজার ২৫০ জন চাষিকে অনুদানের ১৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
এই পদ্ধতি সম্পর্কে খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব কুমার বলেন, ‘ক্লাস্টার পদ্ধতি চিংড়ি চাষের আধুনিক সংস্করণ। এর মাধ্যমে চাষিদের পুকুরের গভীরতা ৪ থেকে ৫ ফুট করা, রোগমুক্ত চিংড়িপোনা সরবরাহ, পানির গুণগত মান ঠিক রাখা এবং পোনার উপযুক্ত খাবার নিয়মিত দেওয়া হয়।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ পদ্ধতিতে চাষের ফলে ২০-৪০ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। চার মাস পর পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন।
প্রকল্পের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাছ চাষিদের সুসংগঠিত করে ৩০০ ক্লাস্টারকে প্রকল্পভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে ২৫টি ঘের। এসব ঘেরের আয়তন ৩৩-১৫০ শতক। এই ৩০০ ক্লাস্টারে মোট জমির পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ হেক্টর। খুলনা অঞ্চলের পাঁচ জেলার ২৫টি উপজেলায় এ প্রকল্প ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়। ২০১৮ সালে গ্রহণ করা এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
খুলনার ৮, বাগেরহাটের ৯, সাতক্ষীরার ৭, যশোরের ২ এবং গোপালগঞ্জের তিনটি উপজেলায় এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্প লক্ষ্যমাত্রার ৩০০টি ক্লাস্টার বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। আর খনন ও পাড় বাঁধাই সম্পন্ন হওয়া ৯০টি ক্লাস্টারে প্রথম কিস্তির অনুদানের ১৩ কোটি ২২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। অনুদান পাওয়া ক্লাস্টারগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে। উৎপাদনের স্বপ্ন নিয়ে পোনা মজুদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাষিরা।
প্রকল্পের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘের প্রস্তুতির অনুদান পাওয়ার জন্য আবেদন করতে বলা হয়। এ অনুদান দিয়ে তারা খনন ও রাস্তা নির্মাণ করা ছাড়া পোনা মজুত, ঘের প্রস্তুত, গুড অ্যাকোয়া প্যাকটিস, বিদ্যুৎ সংযোগ, অফিস কক্ষ নির্মাণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাসহ যাবতীয় খরচ মেটাবেন।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা নতুন রাস্তা চিংড়ি চাষি ক্লাস্টারের সভাপতি শেখ মাহতাব হোসেন বলেন, ‘ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে সফল হয়েছি। মৎস্য অধিদফতরের পরামর্শে ঘের চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। ঘের প্রস্তুত করে ম্যাচিং গ্র্যান্ট পাওয়ার আশায় ছিলাম। একটু দেরি হলেও আর্থিক সাপোর্ট পেয়ে আমরা খুশি।’
কয়রা উপজেলার খড়িয়া চিংড়ি চাষি ক্লাস্টারের সাধারণ সম্পাদক অনিমেষ কুমার বলেন, ‘২২ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করছি। মাটি ও পানির গুণাগুণ আগের মতো না থাকায় উৎপাদন ভালো হয় না। আমরা বেশ কয়েক বছর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খুব চিন্তিত ছিলাম। এ বছর মৎস্য অফিসের সহযোগিতায় দ্বিগুণ উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছি। প্রথম কিস্তির আট লাখ টাকা পেয়েছি।’
কয়রা উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, ‘কয়রায় ১০টি ক্লাস্টার গঠন করা হয়। ক্লাস্টারভুক্ত চাষিদের নিজেদের উদ্যোগে খননের মাধ্যমে ঘেরগুলোর গভীরতা বাড়াতে হচ্ছে।’
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, ‘বাগেরহাটে ১৬টি ক্লাস্টার রয়েছে। ইতোমধ্যে শর্তপূরণ করে ১৬ জন আবেদন করেছেন। আশা করছি উৎপাদন বাড়বে।’
সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের খুলনা বিভাগের উপ-প্রকল্প পরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রি বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এটি একটি কার্যকরী উপায়। দক্ষিণ উপকূলের চাষিদের সুসংগঠিত করে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ করতে পারলে কৃষি অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্লাস্টারভুক্ত হতে হলে ২৫টি ঘের পাশাপাশি হতে হবে। এগুলোর সঙ্গে কোনও ধরনের অবকাঠামো থাকলে হবে না। আর ঘেরের গভীরতা ৪ থেকে ৫ ফুট হতে হবে। ক্লাস্টারভুক্ত হয়ে বাছাই হওয়ার পর চাষিকে নিজ খরচে এই খননসহ ঘেরের পাড় ৫ ফুট চওড়া করতে হবে। এ কাজটি সম্পন্ন হলেই অনুদানের টাকা ওই ক্লাস্টারে প্রদান করা হয়। এ কারণেই এখন পর্যন্ত ৯০টি ক্লাস্টারে অনুদানের প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হয়েছে। অনুদান পাওয়া ৯০টি ক্লাস্টারের ৭৫টিতে পোনা ছাড়া সম্পন্ন হয়েছে। চার মাস পর উৎপাদন দেখে ফলাফল জানা যাবে।’