আনসার-ভিডিপির এক প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ!
বাংলাদেশ

আনসার-ভিডিপির এক প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ!

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা আনসার-ভিডিপি কার্যালয়ের প্রশিক্ষক (টিআই) মো. সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভিডিপি সদস্যদের নামে ঋণ নিয়ে টাকা আত্মসাৎ, সম্মানীর টাকা না দিয়ে নিজের পকেটে নেওয়া, ঘুষ, কাঠ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় আনসার-ভিডিপির প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত উপজেলায় বাহিনীটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, লক্ষ্মীছড়িতে যোগদানের পর তাকে অফিসে খুব একটা দেখা যেত না। কাঠ ব্যবসার কারণে তাকে মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গায় আবার কখনও জেলা শহরে ঘুরতে দেখা যায়। মানিকছড়ির ফার্নিচার দোকানে আবার কখনও বনবিভাগের অফিসে দেখা যেত এই প্রশিক্ষককে। ব্যবসার নামে মানুষের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনেও অনিয়ম করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

দিঘীনালা উপজেলার মেরং এলাকার আবদুর রহমান বলেন, ‘টিআই সিরাজুল আমার কাছ থেকে গাছ কেনেন। পরে টাকা না দিয়ে ব্ল্যাংক চেক দেন। সেই চেক দিয়ে মামলা করি এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।’

এদিকে, জালিয়াতি করে ভুয়া ছবি ও পরিচয় পত্র দেখিয়ে আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে লাখ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ, চাকরি দেওয়ার নামে ঘুষ বাণিজ্য, এমনকি জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়া ভিডিপি সদস্যদের নামে বরাদ্দ সম্মানীর টাকা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে এসবের অডিও রেকর্ড, অভিযোগের যাবতীয় কপি পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে সম্প্রতি ১৩ জন ভিডিপি সদস্যদের নামে ৫০ হাজার টাকা করে ছয় লাখ ৬৫ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রকৃত ঋণগ্রহীতাদের হাজির না করে পরিচয়পত্র একজনের এবং ছবি আরেকজনের দেখিয়ে ঋণ নিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন সিরাজুল। তবে কতজনের নামে এ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন এর প্রকৃত সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। এ বিষয়ে একাধিক ভিডিপি সদস্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এই বিষয়ে উপজেলা কার্যালয়ে অভিযোগ করে সমাধান না পেয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দেন লক্ষ্মীছড়ি ২নং হিল ভিডিপি প্লাটুনের ল্যা. নায়েক মো. আমির হোসেন। অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ আবেদন করি। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও ঋণ পাস না হওয়ায় ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে বলা হয়, আমার নামে ঋণ পাস হয়েছে। সিরাজুল ইসলাম উক্ত টাকা বুঝে নিয়েছেন।’

‘বিষয়টি তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অস্বীকার করেন। আমি পুনরায় ব্যাংকে গিয়ে দেখি আমার পরিচয়পত্র রয়েছে, কিন্তু ছবি অন্যজনের। আমার স্বাক্ষর জাল করে এ ঋণ ওঠানো হয়েছে। বর্তমানে আমার বেতন থেকে ঋণের কিস্তি বাবদ এক হাজার ৮১৫ টাকা প্রতি মাসে কেটে নেওয়া হচ্ছে।’

একই অভিযোগ করেছেন লক্ষ্মীছড়ি ৭নং হিল আনসার-ভিডিপি প্লাটুনের ল্যা. নায়েক মো. কামরুল ইসলাম। তিনি জানান, তিনি কোনও ঋণ নেননি। অথচ তার নামে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে মর্মে বেতন থেকে মাসিক টাকা কাটা হচ্ছে।

৭নং প্লাটুনের নায়েক মো. সোহাগ জানান, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তার বেতন থেকে ঋণের কিস্তি কেটে নেওয়া হয়েছে। তিনি এই বিষয়ে টিআই সিরাজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘এটা ব্যাংক ম্যানেজার ভুল, অন্যজন হয়তো ঋণ তুলেছে ভুলে তোমার নামে লেখা হয়েছে।’ কিন্তু ব্যাংকে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, ‘টিআই সিরাজুল টাকা নিয়েছেন’।

আরেক ভিডিপি সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, তার নামে ঋণ পাস হয়েছে জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম তাকে খাগড়াছড়িতে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে বলেন, ‘তোমার টাকাটা আব্দুল মালেক নিয়ে গেছে। মালেকের নামে ঋণ পাস হলে তোমাকে দেওয়া হবে’। মালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, কোনও টাকা নেননি।

২০২১ সালের মহান বিজয় দিবসের প্যারেডে অংশ নেওয়া ৩২ ভিডিপি সদস্যদের নামে এক হাজার ৫০ টাকা করে ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। সেই টাকা কাউকে না দিয়ে আত্মসাৎ করাও অভিযোগ রয়েছে এই টিআই-এর বিরুদ্ধে।

উপজেলা আনসার-ভিডিপির কোম্পানি কমান্ডার মো. আছির উদ্দিন বলেন, ‘ভাতার টাকা অনেক আগেই উত্তোলন করা হয়েছে, কিন্তু এখনও কোনও সদস্য এই টাকা পাননি। বর্তমান উপজেলা আনসার-ভিডিপি অফিসারের কাছে অভিযোগ করলে তিনি বিষয়টি সমাধান করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। তবে এখনও সমাধান হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ কোনও প্রতিবাদ করলে টিআই চাকরি থেকে বরখাস্ত করার হুমকি দেন। তাই অনেকে ভয়ে অভিযোগ করেন না। চাকরি দেওয়ার নামে নিরীহ পাহাড়ি-বাঙালিদের থেকে বহু টাকা নিয়েছে। কিন্তু চাকরি কাউকে দিতে পারেনি।’

উপজেলা মহিলা কোম্পানি কমান্ডার জামিরুননেছা জেলা কমান্ডেন্ট বরাবর দেওয়া এক অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজুল ইসলাম আমার মেয়েকে চাকরি দেবে বলে ২৫ হাজার টাকা নেয়। কিন্তু পরে জানতে পারি, আসলে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি ছিল ভুয়া ও মিথ্যা। ওই টাকা ফেরত চাইলে টিআই নানা প্রতারণা করে।’

বর্মাছড়ির রুপন চাকমা দাবি করেন, তিনি ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন চাকরির জন্য। কিন্তু চাকরি এবং টাকা কোনোটাই ফেরত পাননি।

জেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা দীপ্তি প্রভা বড়ুয়া বলেন, ‘যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। যেসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, তাদের টাকাও ফেরত দিতে বলা হয়েছে।’

তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশিক্ষক সিরাজুল ইসলাম দাবি করেন, ‘কয়েকজন ভিডিপি সদস্য আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যারা অভিযোগ করছে অনেকেই ঋণ পেয়েছে।’ তবে কাঠ ব্যবসার লেনদেন সংক্রান্ত চেকের মামলা, সরকারি ভাতা, জাতীয় দিবসে কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়াদের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি তিনি।

Source link

Related posts

রাজশাহীতে ৮টা বাজার সঙ্গেই পড়লো দোকানের শাটার

News Desk

‘এক দফার নামে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চায় বিএনপি-জামায়াত’

News Desk

বৃষ্টির অভাবে ব্যাহত আমন চাষ, পাট নিয়ে বিপাকে কৃষক

News Desk

Leave a Comment