‘আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী’ পরিচয়ে কোটি টাকা ও জমি আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে বিজ্ঞানী সাইফুলসহ ছয়জনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই মামলার অপর ১০ আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র মন্ডল রিমান্ড ও কারাগারে পাঠানোর এ আদেশ দেন।
আগামী ২০৫০ সালে বাংলাদেশ পানির নিচে ডুবে যাবে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে এই দেশকে জাগিয়ে রাখা যায় সেই গবেষণা থেকেই একটি থিউরি আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী সাইফুল ওরফে সায়েন্টিস্ট সাইফুল (৫৪)। থিউরি অনুযায়ী এই প্রতারক মানুষদের বুঝিয়েছেন- এই সমস্যা থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে হলে সমুদ্রের পাড়গুলো ১৫ ফুট উঁচু করতে হবে। এরপর সেখানে পরিবেশ বান্ধব করতে উঁচু পাড়ের গাছ লাগানো হবে। এতে সমুদ্রের পানি আর পাড় ডিঙিয়ে আসতে পারবে না।
এসব কথা ও যুক্তি উপস্থাপন করে নোয়াখালী, লক্ষীপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে বিঘায় বিঘায় জমি ও কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রতারক বিজ্ঞানী সাইফুল ইসলাম ওরফে সায়েন্টিস্ট সাইফুল। শুধু তাই নয় সম্প্রতি তার নতুন উদ্ভাবিত থিউরি করোনা ভাইরাস নিয়ে। করোনা রোগের নিরাময় করতে সাইফুল কয়েল টেকনিক বানায়। তার ভাষ্য কয়েলের মধ্যে আয়োডিন জাতীয় দ্রব্য দিয়ে ওই কয়েল ঘরে জ্বালালে তার ধোঁয়া করোনা আক্রান্ত মানুষের নাক ও মুখ দিয়ে ভেতরে গিয়ে করোনা ভাইরাস গলায় অবস্থান করতেই মারা যাবে।
বুধবার (১৬ জুন) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতার প্রতারক ভুয়া বিজ্ঞানী সাইফুল ইসলাম ওরফে সায়েন্টিস্ট সাইফুলের কার্যকলাপ সঙ্গে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, প্রতারক বিজ্ঞানী সাইফুল ইসলাম জলবায়ু নিয়ে তার স্ব উদ্ভাবিত থিউরিগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন প্রজেক্ট, বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনা, পরিবেশ বান্ধব যানবাহন, ডায়াবেটিক নিরাময় প্রতিষেধক, হৃদরোগ নিরাময় প্রতিষেধক প্রজেক্ট এবং করোনা নিরাময় কয়েল টেকনিক প্রজেক্টে বিনিয়োগের জন্য সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এসব প্রজেক্টে যারা ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করবেন তারা পরবর্তীতে কোটি টাকা মুনাফা/লাভের প্রস্তাবও দেয়। এছাড়াও এসব প্রজেক্টের কাজের জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে জমির মালিকানাও শেয়ারের প্রস্তাব দেয় এবং ভুয়া কাগজাদি করে তা নিজের কোস্পানি রাজা-বাদশা নামে চুক্তি করেন।
প্রতারণার জন্য বিজ্ঞানী সাইফুল স্বল্প শিক্ষিত ধনী ব্যবসায়ী, জমিজমা সম্পত্তির মালিকদের টার্গেট করতেন।
মঙ্গলবার (১৫ জুন) রাতে রাজধানীর উত্তরা ও টাঙ্গাইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীর ভুয়া পরিচয়ে কোটি কোটি টাকা ও জমি আত্মসাৎকারী চক্রের মূলহোতা সাইফুল ইসলাম ওরফে বিজ্ঞানী সাইফুল ওরফে সায়েন্টিস্ট সাইফুলসহ (৫৪) ১৬ জনকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
চক্রের বাকি সদস্যরা হলেন- সাইফুলের স্ত্রী মোছা. বকুলি ইয়াসমিন (৪৬), ছেলে মো. ইমরান রাজা (২৫) ও তার স্ত্রী কাকুলী আক্তার (১৯), রোমান বাদশা (১৮), মো. আনিসুজ্জামান সিদ্দিকী (৫৩), মো. নাজমুল হক (৩০), তারেক আজিজ (৪০), বেল্লাল হোসেন (৬১), আব্দুল মান্নান (৫০), শিমুল মিয়া (২৪), নুরনবী (৪৫), আবুল হাশেম (৪২), আলী হোসেন (৩৮), শওকত আলী (৫০), রোকনুজ্জামান (৫০)।
অভিযানে সাইফুলেন রাজা-বাদশা গ্রুপের উত্তরা কার্যালয় থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, দুই রাউন্ড গুলি, দুই বোতল বিদেশি মদ, ছয়টি সীল, নগদ ৪৫ হাজার ৪৬০ টাকা, ২০টি মোবাইল ফোন, ১৪টি চেক বই, ১২টি ভিজিটিং কার্ড, ছয়টি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চিঠি, বিভিন্ন মূল্যের ১২১টি জাল স্ট্যাম্প, তিনটি চুক্তি নামা দলিল, তিনটি বই, নয়টি স্বাক্ষরিত চেক ও বিদেশি নেতাদের ভুয়া চিঠি পত্র জব্দ করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১১ সাল থেকে (১০/১১ বছর) প্রতারক সাইফুল ইসলাম বিজ্ঞানী সেজে প্রতারণা করেছ আসছিল। প্রতারণার জন্য রাজা-বাদশা গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন সাইফুল। সেই প্রতিষ্ঠানের তিনি চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। তার সঙ্গে প্রতারণা কাজে পরিবারের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধু, প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে ছিলেন।
তিনি বলেন, গ্রেফতার সাইফুল ইসলামের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিয়ে পাশ। সে প্রথমে টিউশনি করতেন। পরবর্তীতে পোল্ট্রি ফিড ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। তার নামে এ পর্যন্ত পাঁচটি প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে সবগুলো মামলা ২০১৭ সালের পর থেকে হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতারক বিজ্ঞানী সাইফুল সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র, চিঠি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়ের এরদোগানের সঙ্গে নিজের ছবি জোরা লাগিয়ে এবং তাদের পাঠানো বিভিন্ন চিঠি দেখিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতেন। এবং সে তাদের কাছ থেকে এই প্রজেক্টে বিনিযোগের জন্য এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করাতে পারবেন।
তিনি বলেন, প্রতারক চক্রের উত্তরা কার্যালয় ও টাঙ্গাইলের বেপারী পাড়ায় একটি শাখা রয়েছে। অফিসে ১৫ জন্য সহযোগী কাজ করেন। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে আরও ৩০ জনের বেশি সদস্য নিয়োগ প্রাপ্ত রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এজেন্টরা আলোচনার মাধ্যমে টার্গেট নির্ধারণ করতো। এরপর চক্রের মুলহোতা সাইফুলের সঙ্গে দেখা করান। এরপর বিজ্ঞানী সাইফুল মানুষদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলতেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতারক সাইফুলের বিরুদ্ধে আরও ১৮ জন ভুক্তভোগী মামলা করতে প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন।
গ্রেফতার আসামীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।