‘মোর কলিজার টুকরাটা এমনে সুইয়া রইছে কেন? আয় বাপধন এই অভাগী মায়ের কোলে ফিইরা আয় বাপ।’ নাড়িছেঁড়া ধন ছেলে হারিয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন আলেয়া বেগম। কিন্তু নিথর দেহ কোনও সাড়া দিচ্ছিল না। গতকাল সোমবার (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে গণভবন অভিমুখে বের হওয়া মিছিলে অংশ নিয়ে সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে উঠে তার ছেলে রাশিদুল ইসলাম (২২) চলে গেছেন যোজন যোজন দূরে। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে লাশ পৌঁছালে মরদেহের পাশে এভাবেই আহাজারি করেন মা আলেয়া বেগম।
আলেয়া বেগমের শোকাতুর প্রশ্ন, ‘মিছিলত গেছিল জন্যে মোর বাপের বুকত গুলি করছে রে! বাপের (ছেলের) কী দোষ আছিলো? গুলি করি মারলেন কেনে?’ ছেলেহারা মায়ের এসব প্রশ্ন বুকফাটা কান্নায় মিলিয়ে যায়, উত্তর মেলে না।
রাশিদুলের বাড়ি উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের কাঠগীরাই গ্রামে। ওই গ্রামের বাচ্চু মিয়া-আলেয়া বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট তিনি। মাত্র পাঁচ দিন আগে ঢাকায় যান কাজের সন্ধানে। সোমবার মিছিলের দিকে ছোড়া তিনটি গুলি মাথায় ও বুকে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার। তার মৃত্যুতে মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে স্বামীহারা হয়েছেন তার নববধূ আশামণি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে দাম্পত্য শুরু করা এই তরুণীর হাতের মেহেদির রঙ মিশে যাওয়ার আগেই হয়েছেন স্বামীহারা। ঘাতকের বুলেট তার সব স্বপ্ন বিদীর্ণ করেছে।
আশামণি বলেন, ‘স্বামী আমাকে তার সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েছিল। তিন মাস পরে তার আসার কথা। কিন্তু পাঁচ দিন পর ফিরি আসলো। সে এখন কোনও কথা কয় না। আমার দিকে চায়া দেখে না। সে এখন লাশ। এই লাশ দিয়া আমি কী করবো? আমার স্বামীকে আমার কাছে ফেরায় দেন।’
বাবা-মা, স্ত্রী আর স্বজনদের আহাজারিতে প্রতিবেশী ও দর্শনার্থীরা আবেগ সামলে নিতে পারছিলেন না। পরিধানের কাপড়ে চোখ মুছছিলেন বারবার।
কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন এই দিনমজুর, জানতে চাইলে রাশিদুলের ভাবি মৌসুমি খাতুন বলেন, ‘স্বামী আলমগীর হোসেনসহ আমরা ঢাকায় যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় থাকি। স্বামী রিকশা চালান, আমি পোশাক কারখানায় কাজ করি। রাশিদুল পাঁচ দিন আগে আমাদের কাছে গিয়ে “আদমজী গার্মেন্টস”-এ চাকরি নেয়। মাত্র দুই দিন ডিউটি করেছে। সোমবার সকালে বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু বাইরে গোলাগুলি চলায় আধাঘণ্টা পরে আবারও বাসায় ফিরে আসে। বেলা ১১টার দিকে সে বাসা থেকে বের হয়ে মিছিলে যোগ দেয়। পরে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।’
আরেক ভাবি মুন্নী বেগম বলেন, ‘সোমবার বেলা ৩টার দিকে রাশেদুলের নম্বর থেকে ফোন আসে। আমাকে এক অপরিচিত ব্যক্তি বলেন, “রাশিদুলের আপনি কে হন? সে মিছিলে পুলিশের গুলি খেয়েছে। আমরা তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়েছি। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসেন।” বিকালে মেডিক্যালে গিয়ে অনেকের সঙ্গে রাশিদুলের লাশ পাই। তার মাথায়, বুকে মোট তিনটি গুলি লেগেছে।’
ছেলের এমন অকাল মৃত্যুতে বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন দরিদ্র বাবা বাচ্চু মিয়া। আদালতের বারান্দায় যাওয়ার সামর্থ্যহীন এই দিনমজুর ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেছেন। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাওয়ার চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে তিনি বিচার চেয়েছেন দেশবাসীর কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যাটা কী দোষ করলো, তাকে গুলি করি মারলো! আমি দেশবাসীর কাছে এর কঠিন বিচার চাই।’
মঙ্গলবার দুপুরে দুধকুমার নদের তীরবর্তী গ্রামের বাড়ি সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে রাশিদুলকে দাফন করা হয়। দাফনে অংশ নেওয়া মুসল্লিসহ গ্রামবাসীর প্রশ্ন, এমন হত্যার বিচার কি আদৌ মিলবে?
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন কুড়িগ্রামের তিন বাসিন্দা। তাদের দুজন ঢাকায় নির্মাণশ্রমিক এবং অপরজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন। পরিবারের দাবি, তাদেরও কেউই আন্দোলনে অংশ না নিলেও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।