রাজশাহীতে মৌসুম শুরুর আগেই বীজ আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেট করে কারসাজির মাধ্যমে কৃষকদের কাছে ৬০ টাকা কেজির বীজ ৯০ টাকায় বিক্রি করছে তারা। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। শেষ পর্যন্ত বীজ পাবেন কিনা, এ নিয়েও শঙ্কায় আছেন কোনও কোনও চাষি।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, এবার বীজ আলুর সংকট নেই, সংকট হবেও না। কারণ চাহিদার চেয়েও বেশি মজুত আছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কৃষকদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তাদের দোকান ও গুদামে বীজ আলু রাখছেন না। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে মণপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেশি রেখে অজ্ঞাত স্থান থেকে কৃষকের কাছে বীজ আলু পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে লোকদেখানো জরিমানা ছাড়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন।
চাহিদার বেশি মজুত থাকা সত্ত্বেও অস্থিতিশীল বাজার
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, রাজশাহী জেলায় এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর জমি। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। বীজ আলুর চাহিদা রয়েছে ৫৭ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টনের। জেলার ৯ উপজেলার হিমাগারগুলোতে বীজের মজুত ছিল ৫৯ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে ২২ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন বীজ বাজারে ছাড়া হয়েছে। এখনও মজুত আছে ৩৭ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। হিসাবে চহিদার চেয়েও বেশি আছে এক হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কাছে বীজ মজুত রয়েছে আরও ৬০০ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে দুই হাজার ৫৫০ মেট্রিক টন বীজ মজুত থাকা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের কারণে অস্থিতিশীল রাজশাহীর বীজ আলুর বাজার।
কৃষি অধিদফতর, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজশাহীতে যে পরিমাণ বীজ আলুর প্রয়োজন পড়ে তার অধিকাংশই চাষিরা উৎপাদন করেন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা সাধারণত বীজ কেনেন। তারা কখনও অন্য চাষি আবার সরকারি সংস্থা কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বীজ কিনে থাকেন। মোট চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি সংস্থা বিএডিসি সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়া ব্র্যাকসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বীজ উৎপাদন করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তা কৃষকদের কাছে বিক্রি করে।
কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি-সেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বীজ সাধারণ ভালো হয়। এ কারণে চাষিদের আগ্রহ থাকে কেনার। কিন্তু এই বীজ ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করে ডিলার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কারসাজির মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।
৬০ টাকার বীজ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি
সরকারি সংস্থা বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, বিএডিসি সাধারণত তিন জাতের বীজ বিক্রি করে। তা হলো অ্যাস্টেরিক, ডায়মন্ড ও সানশাইন। প্রতি কেজি অ্যাস্টেরিক বীজ ডিলার পর্যায়ে ৫৯-৬০ টাকা ও চাষি পর্যায়ে ৬৫-৬৬ টাকা, ডায়মন্ড ডিলার পর্যায়ে ৫৭-৫৮ ও চাষি পর্যায়ে ৬৩-৬৪ টাকা এবং সানশাইন ডিলার পর্যায়ে ৫২-৫৪ ও চাষি পর্যায়ে ৫৮-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু চাষি পর্যায়ে ৬০-৬৫ টাকা কেজি দরে কোনও জাতের বীজই পাওয়া যাচ্ছে বলে জানালেন চাষিরা। তারা বলছেন, প্রতি কেজি বীজ সর্বনিম্ন ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। নানা অজুহাত ও সংকট দেখিয়ে ১০০ টাকাও বিক্রি করছেন কেউ কেউ।
এমনটি জানিয়েছেন পবা উপজেলার আলু চাষি সাগর আলী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মৌসুম শুরুর আগেই বীজ আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কারসাজির মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তাদের দোকান ও গুদামে বীজ আলু রাখছেন না। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে মণ প্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেশি রেখে অজ্ঞাত স্থান থেকে কৃষকের কাছে বীজ পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে বেশিরভাগ চাষি হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
বীজের সংকট নেই
রাজশাহী নগরের গ্রেটার রোড এলাকার বীজ আলুর প্রজেক্ট ব্যবসায়ী খোকন তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যবসা করি। বীজ নিজেরাই উৎপাদন করি। উদ্বৃত্ত থাকলে সেটা বিক্রি করি। এখানে সিন্ডিকেট সক্রিয়। এবার শুরু থেকেই কৌশলে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে তারা। পার্শ্ববর্তী জেলা নওগাঁ, নাটোর ও কৃষ্টিয়ার দিকে বীজের সংকট আছে। অনেক বীজ ওই দিকে যাচ্ছে। আর নানা অজুহাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সাধারণ চাষিদের কাছ থেকে বেশি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।’
শনিবার ১০০ টাকা ও রবিবার (১৭ নভেম্বর) ৯০ টাকা কেজি দরে বীজ বিক্রি হয়েছে উল্লেখ করে খোকন তালুকদার আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকায় তেমন সমস্যা হবে না। অন্য জেলা থেকে আমাদের কাছ থেকে বীজ কেনার জন্য যোগাযোগ করছেন চাষিরা। এবার বীজের সংকট নেই। তবে দাম বেশি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী কোল্ডস্টোরেজ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু বক্কর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজারে ৮০ টাকার ওপরেই সব বীজ বিক্রি হচ্ছে। সম্ভবত এবার রাজশাহীতেই দাম কম। এ কারণে সিন্ডিকেট করে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। তবে বীজের সংকট নেই।’
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, ‘জেলায় যে পরিমাণ বীজ আলু মজুত আছে, তাতে কোনোভাবেই সংকট তৈরি হওয়ার কথা নয়। সংকট হবে না। এরপরও সংকটের অভিযোগ আসছে। আমরা প্রতি উপজেলায় এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন। অভিযোগ পেলেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
সিন্ডিকেট ভাঙতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়শা সিদ্দিকা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খাবার আলু ও বীজ আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। শনিবার আলু ব্যবসায়ী ও চাষিদের নিয়ে সভা করেছি আমরা। সিন্ডিকেটের অভিযোগ পেলেই অভিযান চালানো হচ্ছে।’
বেড়েছে খাবার আলুর দামও
এদিকে রাজশাহীতে সরকার পতনের আগে পাইকারি বাজারে ৫৫ টাকা ও খুচরা বাজারে খাবার আলু ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি খাবার আলুর পাইকারিতে ৭০ ও খুচরা বাজারে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, রাজশাহী জেলায় এ বছর ৯ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। আর আলুর চাহিদা বার্ষিক ৮০ হাজার মেট্রিক টন।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা আলু সরবরাহ করছেন না। একইভাবে সরবরাহ না করে বীজ আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এজন্য মূলত সংকট দেখা যাচ্ছে। যে কারণে খাবারের আলুর দাম কমছে না। আবার কৃত্রিম সংকেটর কারণে বীজ আলু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে এই সিন্ডিকেট ভেঙে যেতো।’