রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় নষ্ট হয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের সৌরবাতি। মেরামত না করায় এরই মধ্যে অধিকাংশ সৌরবাতি বিকল হয়ে গেছে। আর যে কয়েকটি অল্প সময়ের জন্য জ্বলছে, সেগুলোও দিচ্ছে অল্প আলো। এতে করে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছে ‘আলোর প্রকল্প’।
গ্রামকে শহরের রূপে রূপায়িত করতে গ্রামীণ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মোড়, বাজার, মসজিদ ও মন্দিরের সামনে রাতে আলোর ব্যবস্থার জন্য সরকার গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের মাধ্যমে সৌরবাতি স্থাপন করে। গ্রামের পথে রাতের অন্ধকারে আলো ছড়ানোর জন্যই নেওয়া হয়েছিল প্রকল্পটি। সেই বাতির আলো এখন আর সড়কে পড়ে না। সেখানে আগের মতোই ঘুটঘুটে অন্ধকার। অথচ প্রতিটি সৌরবাতি স্থাপনে খরচ হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-২০১৭, ১৭-১৮, ১৮-১৯ ও ১৯-২০ এই চার অর্থবছরে প্রতিটি সৌরবাতি স্থাপনে খরচ হয় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এই চার অর্থবছরে রাজবাড়ীর পাঁচ উপজেলায় ৩৭ কোটি ৫০ লাখ ৩৭ হাজার ১২ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬ হাজার ৮০০টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়।
চার অর্থবছরে রাজবাড়ী সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ১১ কোটি ৮৫ লাখ ৭১ হাজার ৭৩০ টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ১৫৫টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭ লাখ ২৩ হাজার ২৩২, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৮৮, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ কোটি ৮৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৩ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৬৫ লাখ ২২ হাজার ৭২৭ টাকা ব্যয় করা হয়।
পাংশা উপজেলায় ৭ কোটি ৭১ লাখ ৪৯ হাজার ২১৭ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৪০০টি, গোয়ালন্দ উপজেলায় ৭ কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার ৮৯৩ টাকা ব্যয়ে মোট ১ হাজার ২৯৩টি, কালুখালী উপজেলায় ৫ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ৩০৮ টাকা ব্যয়ে ১৯১টি এবং বালিয়াকান্দি উপজেলায় ৫ কোটি ৫৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮৬৪ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ১৫টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়। প্রতিটি সৌরবাতির জন্য ব্যয় হয় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, বাতিগুলো স্থাপন করার পরে আর কখনও দেখভাল করেনি কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ সৌরবাতি বিকল হয়ে গেছে, আর যেগুলো সচল আছে সেগুলোও খুব অল্প সময় ও কম আলো দেয়। তাই গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে এখন বিদ্যুৎ চলে গেলে ভূতুরে অবস্থা বিরাজ করে, সৃষ্টি হয় নিরাপত্তাহীনতা।
গ্রামীণ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো আলো থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ গ্রামীণ জীবনে আসবে শহরের আবহ। এছাড়াও অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ জীবনমানের উন্নতি হবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর। রাতের বেলায় মানুষ যাতে নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে, এটিই ছিল সৌরবাতি প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
সৌরবাতি স্থাপনের উদ্যোগটি সেসময় সব এলাকার মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রশংসার স্থলে এখন হতাশায় রূপ নিয়েছে। প্রকল্পটি গ্রহণ করার আগেই দীর্ঘ মেয়াদে এর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি ভাবা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন সচেতন মহল। সেটি না করায় কোটি কোটি টাকা গচ্চা যেতে বসেছে। অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার এই জনবান্ধব উদ্যোগ।
গোয়ালন্দ উপজেলার মকবুলের দোকান নামক স্থানের হোটেল ব্যবসায়ী মো. নজির মৃধা জানান, সৌরবাতিগুলো স্থাপন করায় তারা এর সুফল ভোগ করছিলেন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই বাতিগুলো বিকল হয়ে পড়ে। যেগুলো জ্বলে সেগুলোও এক ঘণ্টার বেশি আলো দেয় না। রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থানে ভূতুরে অবস্থা বিরাজ করে। এতে করে এলাকায় চুরি-ছিনতাই বেড়েছে।
স্থানীরা জানায়, স্থাপনের কয়েক মাস পর থেকেই বাতিগুলো নষ্ট হতে থাকে। তারা কাউকে কখনও বাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা মেরামত করতে দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে বিকল হয়ে পড়ে থাকায় সৌরবাতিগুলোর প্যানেল, ব্যাটারি এমনকি খুঁটিও চুরি হয়ে যাচ্ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ মণ্ডল জানান, স্থাপিত সৌরবাতিগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদকাল ছিল তিন বছর। বেশ আগেই সৌরবাতি স্থাপনের সময়কাল তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এছাড়া চুক্তির মেয়াদের পর সৌরবাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে জন্য কোনও বরাদ্দ না থাকায় এখন আপাতত কিছুই করা যাচ্ছে না।
বিকল হওয়া সৌরবাতিগুলো হয়তো অল্পকিছু টাকা খরচ করেও মেরামত করে পুনরায় সচল করা সম্ভব বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এতে কোনও বরাদ্দ না থাকায় সেটাও করা সম্ভব হচ্ছে না।’
কালুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. সজীব বলেন, ‘আমার সরকারি বাসভবনের সামনে স্থাপন করা লাইটটিও নষ্ট হয়ে আছে। অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়েছে এটি সত্য। মেরামতের সময়ও পার হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখি কিছু লাইট মেরামত করা যায় কি না।’
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোস্তফা মুন্সী জানান, গোয়ালন্দে স্থাপিত সৌরবাতিগুলো মেরামতের জন্য বিশেষ বরাদ্দ আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। যদি সেটা সম্ভব নাও হয়, তাহলে তিনি নিজে ও স্থানীয়ভাবে তহবিল সংগ্রহ করে বাতিগুলো সচল করার ব্যবস্থা করবেন।