ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে ৩০০ বিঘা জমির ফসল নষ্ট
বাংলাদেশ

ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে ৩০০ বিঘা জমির ফসল নষ্ট

কৃষিজমির ওপর নির্মিত ইটভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও গ্যাসে তিনশ’ বিঘা ধানক্ষেতসহ বিভিন্ন ফল ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের ধনমন্ডল আমীনপাড়া এলাকায় ইটভাটা থেকে গত এক সপ্তাহ ধরে নির্গত বিষাক্ত ধোয়া ও গ্যাসে এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই এলাকার ধানক্ষেতের পাশাপাশি কলা, আম, কাঁঠাল, লিচু, সুপারিসহ বিভিন্ন ফলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন ইটভাটার আশপাশের এলাকার মানুষরা। এ বিষয়ে বার বার কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের ফোন করেও কোনও সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন কৃষকরা। নিরুপায় হয়ে তারা মানববন্ধন করেছেন।

জানা গেছে, ওই এলাকায় শাহীন ব্রিকসের ইটভাটার চতুর্দিকে তিনশ’ বিঘারও বেশি জমিতে বোরো ধান, কলাসহ বিভিন্ন ফসল ও ফলের চাষাবাদ করা হয়েছে। নিজের স্বল্পজমি ছাড়াও বিঘাপ্রতি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে জমি বর্গা নিয়ে কৃষকরা এসব ফসল ও ফল চাষাবাদ করেন। গত কয়েকদিন ধরে বয়ে যাওয়া বাতাসে ওই ইটভাটার ধোয়া ও গ্যাসে বোরো ধানের ক্ষেত ও কলাবাগান নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আম, কাঁঠাল, লিচু, সুপারিসহ বিভিন্ন ফল। বিষয়টি ইটভাটা কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কৃষি বিভাগকে বার বার অবহিত করেও কোনও লাভ হয়নি।

কৃষকরা জানান, অবৈধভাবে কৃষিজমির ওপর প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই শুধু দন্ডপাল ইউনিয়নেই ২০টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে তিনটির অনুমোদন থাকলেও অন্যরা বিনা অনুমতিতে অবৈধভাবে গড়ে তুলেছে। কৃষি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হলেও প্রভাবশালীরা এসব ইটভাটা গড়ে তুলেছে। তারা প্রভাবশালী হওয়ায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা প্রতিবাদ করেও কোনও সুরাহা পাচ্ছেন না। প্রতি বছর ইটভাটার ধোঁয়া ও গ্যাসে ফসল ও ফলের ক্ষয়ক্ষতি হলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এক বছর আগেও এমন ঘটনা ঘটলে ইটভাটা কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও অনেকেই তা পাননি। ঘুরে ঘুরে মালিকপক্ষের কাছে ধরনা দিয়ে যে কয়েকজন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তার পরিমাণও ছিল সামান্য। এবারেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ ওই এলাকার শতাধিক কৃষাণ-কৃষাণি। রবিবার (১০ এপ্রিল) ইটভাটা বন্ধ করে ফসল ও ফলের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ইটভাটার সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র এবং প্রান্তিক চাষিরা জমি বর্গা নিয়ে ধার-কর্জ করে বোরো ধান চাষ করেছেন। বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচ দিয়েছেন। সব মিলে এক বিঘা জমি চাষে (বর্গা ও বীজ, সার, কীটনাশক সেচসহ) তাদের প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বার বার একই ভাটা থেকে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেখার কেউ নেই। ইটভাটা মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কৃষি বিভাগ সবাই তার পক্ষে।

ওই এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম ও সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘ধান গাছ পুড়ে গেছে। এক বিঘা জমিতে স্বাভাবিকভাবে ৩০ থেকে ৪০ মণ ধান উৎপাদন হয়। এখন আর আগের মতো ধান পাবো না। অর্ধেক ধানও পাওয়া যাবে না। গত বছরের আগের বছরও ফলন বেশি হয়নি। এখন ধান না পেলে খাবো না ঋণ পরিশোধ করবো এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি।’

কৃষক ওমর আলী বলেন, ‘উঠতি ধান নষ্ট হচ্ছে দেখে টেনশনে আছি। খেয়ে না খেয়ে ধান আবাদ করেছি। সেই ধান যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাবো। বার বার ফোন করেও কৃষি বিভাগের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দেখতে আসেননি। আমাদের কোনও পরামর্শও দেননি।’

ওই এলাকার কৃষাণি করিমন বেগম বলেন, ‘ইটভাটার গ্যাসে ধানের ক্ষেত পুড়ছে না। পুড়ে যাচ্ছে আমাদের মতো ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বপ্ন। কষ্টে অর্জিত ফসল ঘরে তোলার আগেই পুড়ে চিটা হয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধের চিন্তায় পড়ে গেছি।’ ধান ঘরে না উঠলে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, পরিবার-পরিজনের খাদ্যের জোগান নিয়েও শঙ্কায় আছেন তিনি।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলেন, ‘ইটভাটা সরানোর দাবি করায় ভাটামালিক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিচ্ছেন। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না, কৃষিজমির ওপর থেকে ভাটা সরানোর দাবি করছি।’

সরেজমিন দেখা গেছে, সবুজ ক্ষেতের ধানগাছ ধোঁয়া ও গ্যাসের কারণে লালচে হয়ে গেছে। পাতা কুঁকড়ে গেছে। ধানের শীষ পরিণত হয়েছে চিটায়। কলাবাগানের কলা ও পাতা পুড়ে যাচ্ছে। ইটভাটার দুর্গন্ধে এলাকায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি ও কৃষি বিভাগের কাউকেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দেখা যায়নি।

গত কয়েকদিন ধরে ধানগাছের এই অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্যে স্থানীয় কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা স্থানীয় কৃষকদের জন্য তার হাতে সময় নেই। তিনি ব্যস্ত আছেন। ট্রেনিংয়ে আছেন। ফোন করায় তিনি কৃষকদের ধমক দেন বলেও জানান কৃষকরা। ঘটনাস্থল থেকে ওই কর্মকর্তাকে ফোন করে পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তবে ভাটার মালিকের কাছে ধানক্ষেতে কীটনাশক ছিটাতে পরামর্শ দিয়ে এসেছেন বলে জানান। বিষয়টি এতটা জটিল নয় বলেও তিনি জানান।

দন্ডপাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজগর আলী বলেন, ‘আমি অসুস্থ। কৃষকদের মুখে আমি বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমি ভাটার মালিককে বলে দিয়েছি কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে।’

শাহীন ব্রিকসের মালিক মো. শাহীন হোসেনকে ফোন করলে তিনি পঞ্চগড়ে রয়েছেন, পরে কথা বলবেন বলে জানান। তবে তার ভাটার ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন জানান, কৃষকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধানক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। সমস্যা কেটে যাবে। প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রধান তৌহিদুল বারী বাবু জানান, নিচু চিমনি দিয়ে প্রচুর পরিমাণে ভারী সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ভারী সালফার গ্যাস বাতাসে নিচের দিকে আসায় ফল ও ফসলের কাণ্ড এবং পাতায় ঢুকে তা নষ্ট করে দিচ্ছে। ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে দিগন্তজোড়া বোরো ধানের শীষ শুকিয়ে যাচ্ছে।

পঞ্চগড় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানি না, আমাকে কেউ জানায়নি। আপনাদের মুখেই শুনলাম।’ দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবেন বলে জানান। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বিষয়ে অভিযোগ করলে তিনি বিষয়টি দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে জানানোর পরামর্শ দেন।

Source link

Related posts

পুরস্কার নেওয়ার পরই শেষ অরন্য চিরান ‘বিতর্ক’

News Desk

ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আয়োজনে ‘সাহিত্য মেলা’

News Desk

উল্লাপাড়ায় পঞ্চম শ্রেণীর শিশু ধর্ষণ, ২ আসামী গ্রেফতার

News Desk

Leave a Comment