গ্রন্থাগারকে বলা হয় ‘জনতার বিশ্ববিদ্যালয়’, যেখান থেকে সাধারণ মানুষ আগ্রহ থাকলে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায়। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে যখন গণগ্রন্থাগার ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৩৫ সালে কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ১৮৫০ সালের ১৪ আগস্ট ‘পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট অব ইংল্যান্ড’ পাস হওয়ার পরের সময়কে বলা হয়ে থাকে ‘পাবলিক লাইব্রেরি মুভমেন্ট’। কারণ এই আইনের ফলে তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে গণগ্রন্থাগার, যার ছোঁয়া লাগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গেও। ১৮৫৪ সালে বগুড়া, যশোর, বরিশাল ও রংপুরে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলা ট্রিবিউনের চার জেলার প্রতিনিধিরা সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন দেশের ১৬৮ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক গণগ্রন্থাগারগুলোর বর্তমান অবস্থা। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস (৫ ফেব্রুয়ারি) উপলক্ষে এই বিশেষ আয়োজন।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রথম গ্রন্থাগার বলা হয় যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিকে। কারণ এর প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে আছে নানামুখী মত। নথিতে ১৮৫৪ সাল থাকলেও গ্রন্থাগার বিষয়ক গবেষক ড. মোফাখখার হোসেনের দাবি, যশোর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫১ সালে। এর সাবেক সম্পাদক এবং যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান ‘যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি’ শিরোনামের একটি লেখায় উল্লেখ করেন, শ্রী বিষ্ণুশর্মা পণ্ডিত লিখিত নিবন্ধ অনুসারে যশোর পাবলিক লাইব্রেরির ১৮৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত। ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমির স্মারকগ্রন্থে লেখাটি প্রকাশিত হয়।
সেই হিসাবে অনেকের মতে, যশোর পাবলিক লাইব্রেরি পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রথম গণগ্রন্থাগার। যদিও ১৮৫১ সালে যশোর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হলেও কে বা কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, কোথায় এটি তৈরি হয়েছিল, সেসবের কোনও দালিলিক প্রমাণ মেলেনি। তবে অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফ হোসেন (লাইব্রেরি সম্পাদক, ১৯৬৩-১৯৮৩) এক লেখায় ‘পটল ময়রা’ নামে একজনের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে লিখেছিলেন, ‘যশোরের কিছু বিত্তবান উৎসাহী মানুষ লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে যশোর ইনস্টিটিউট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যেখানে রয়েছে, তার আশেপাশে কোথাও একটি খড়ের ঘরে সেই লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়।’
নামকরণে পরিবর্তন
বর্তমানে যশোর গণগ্রন্থাগারের নাম ‘যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি’। বিভিন্ন নথিতে পাওয়া যায়, ১৯২৮ সালে রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ আর্য থিয়েটার ও টাউন ক্লাবকে নিয়ে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন যশোর ইনস্টিটিউট। রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার ছিলেন নড়াইলের জমিদার, যশোরের বিশিষ্ট আইনজীবী, যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান ও একইসঙ্গে যশোর জেলা বোর্ডের মনোনীত সভাপতি। তার ভূ-সম্পত্তির ওপরেই গড়ে ওঠে ইনস্টিটিউট।
যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত ‘নৈকট্য’ প্রকাশনার ২০১৭ সালের জুলাই সংখ্যায় আবু জাহিদের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৭৯ সালের ১৪ অক্টোবর ইনস্টিটিউটের বার্ষিক সাধারণ সভায় হরেন্দ্র কুমার দাস কর্তৃক প্রস্তাবকৃত এবং গোলাম ইয়াজদান চৌধুরী সমর্থিত যশোর ইনস্টিটিউটের সংবিধানের ৪৯ পাতার দ্বিতীয় লাইনে ‘লাইব্রেরি সেকশন অ্যাজ দ্য যশোর পাবলিক লাইব্রেরি’ নামটি পরির্বতন করে ‘যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি’ নামকরণের প্রস্তাব হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
কীভাবে চলছে গণগ্রন্থাগারটি
যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারিভাবে। এর মূল সংগঠন যশোর ইনস্টিটিউটের সম্পদ থেকে অর্জিত অর্থ দিয়েই মূলত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দেওয়া হয়। বর্তমানে যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিতে কর্মরত আছেন মোট ১১ জন। তাদের মধ্যে লাইব্রেরিয়ান-১, ক্যাটালগার-১, লাইব্রেরি সহায়ক-১, লাইব্রেরি সহায়ক কাম কম্পিউটার অপারেটর-১ এবং অন্যরা লাইব্রেরি কর্মী।
যশোর ইনস্টিটিউটের সম্পদের মধ্যে রয়েছে– ৩ দশমিক ২৪ একর জমিতে যশোর তসবির মহল (সিনেমা হল), বি. সরকার ঘূর্ণায়মান মঞ্চ (অবিভক্ত বাংলার প্রাচীনতম নাট্যমঞ্চের একটি), ইনস্টিটিউট নাট্যকলা সংসদ, রওশন আলী মঞ্চ (আধুনিক মানের উন্মুক্ত মঞ্চ), স্বাধীনতা মঞ্চ (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভাস্থল, যেখানে বক্তৃতা করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাজউদ্দিন আহমেদ), শত বছরের পুরনো টাউন হল (আলমগীর সিদ্দিকী হল), গ্রন্থাগার লাগোয়া টাউন হল মাঠ (মুন্সী মেহেরুল্লাহ ময়দান), শহরের এমএম আলী রোডে ৩৩টি দোকানসহ ইনস্টিটিউট মার্কেট এবং শহরের আরএন রোডে প্রায় ৪৭ শতক জমিতে ১৭টি দোকানসহ উন্মেষ মার্কেট।
সদস্য সংখ্যা
যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য সংখ্যা ২৮৮ জন। বলা প্রয়োজন, আলাদাভাবে এখানে সদস্য হলেও মূলত যারা ইনস্টিটিউটের সদস্য তারাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণগ্রন্থাগারটির সদস্য। বর্তমানে যশোর ইনস্টিটিউটের মোট সদস্য ৩ হাজার ৪৬৫ জন। এরমধ্যে দাতা সদস্য ৯২, জীবন সদস্য ১ হাজার ৩৭৮ এবং সাধারণ সদস্য ১ হাজার ৯৯৫ জন। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগে সদস্য রয়েছে ২৮৮ জন; যার মধ্যে পাঠাগার বিভাগে ২৮৮, ক্রীড়া বিভাগে ১৫৫, নাট্যকলা বিভাগে ৭৬, সিআরসিতে (চাঁদামুক্ত শিশু ও কিশোর সদস্য) ৫ জন।
সদস্য প্রক্রিয়া
যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য হতে হলে প্রথমে প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ টাকা মূল্যের একটি ফরম সংগ্রহ করতে হয়। পরে ৫০০ টাকা জামানত, ২০০ টাকা ভর্তি ফি এবং প্রতিমাসে ২০ টাকা হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। তবে ১৬ বছরের নিচে শিশুদের জামানত বাবদ ৩০০ টাকা (সাধারণ সম্পাদকের অনুমোদন সাপেক্ষ) নেওয়া হয়।
কত বই আছে গণগ্রন্থাগারে
যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিতে মোট তালিকাভুক্ত বইয়ের সংখ্যা ৯৩ হাজার ১৭৩টি। এছাড়া প্রায় ৭ হাজার বই রয়েছে, যেগুলো এখনও তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এরমধ্যে বাংলা ভাষার ৭৩ হাজার ১৩৭টি, ইংরেজি ভাষার ২০ হাজার ৮টি, উর্দু ভাষার শতাধিক, আরবি ভাষার একশ’র কাছাকাছি এবং হিন্দি ও উর্দু ভাষায় লিখিত কিছু বই রয়েছে।
গণগ্রন্থাগার সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে হাতে লেখা প্রায় ২০০ পাণ্ডুলিপি আছে। এরমধ্যে কিছু তুলট কাগজ ও তালের পাতায় লেখা। বেশিরভাগই সংস্কৃত ভাষায় লেখা। তালপাতার পুঁথি, মহাকবি কালিদাসের হাতে লেখা পুঁথি, প্রাচীন রামায়ণ এবং নলখাগড়ার কলম ও ভূষা কালিতে লেখা দুর্গাপূজা পদ্ধতির বর্ণনা আছে। মহাভারত ছাড়াও শ্রী রঘুরাম কবিরাজ, শ্রী কাশিরাম দাশ, ত্রিলোচন দাস, শ্রী ভর্ত্তৃহরি, পদ্মনাম দত্ত, শ্রী রাম দত্ত, অমর সিংহ, শ্রী মচ্চানক্যের লেখা পাণ্ডুলিপিও আছে। মোট গ্রন্থের ৬০ শতাংশ উপন্যাস, ৩০ শতাংশ রেফারেন্স বুক এবং গবেষণাগ্রন্থ আছে ১০ শতাংশ।
লাইব্রেরির ক্ষতিসাধন
দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘটনায় যশোর পাবলিক লাইব্রেরি বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাবেক লাইব্রেরি সম্পাদক অধ্যাপক আমিরুল আলম খানের মতে, ইতিহাসের বড় বড় ঘটনায় কয়েকটি দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণগ্রন্থাগারটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি করে এখানে। বাস্তুচ্যুত হয় লাইব্রেরি। সেই সময় লাইব্রেরি ভবন, অনেক সম্পদ ও দলিলপত্র নষ্ট হয়; হারিয়ে যায় অনেক মূল্যবান উপাদান।
অধ্যাপক আমিরুল আলম খান আরও জানান, ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের সবাই কোনও না কোনোভাবে লাইব্রেরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় প্রথমবার পুলিশ এই গ্রন্থাগারে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয় অনেক মূল্যবান বই। একইসঙ্গে অনেক বই বাজেয়াপ্ত করে। পুলিশি হামলার মুখে তৎকালীন ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ও লাইব্রেরি সম্পাদকসহ অনেকেই দেশত্যাগে বাধ্য হন। জেলা প্রশাসক বাতিল করে দেন ইনস্টিটিউটের নির্বাচিত কমিটিকে।
পাঠক বৃদ্ধিতে উদ্যোগ
লাইব্রেরি সম্পাদক এস নিয়াজ মোহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিতে লাইব্রেরির পক্ষ থেকে নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনাকাল শুরুর আগে আমরা যশোরের ১৬টি স্কুলে শিক্ষার্থীদের গণগ্রন্থাগারে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছি। কিন্তু আমাদের সেই কাজ সফল হয়েছে খুব কম, কারণ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির চাপে থাকতে হয়। তবে কিছু মধ্যবয়সী মানুষকে লাইব্রেরিমুখী করা গেছে।
গত ১০ বছরে গণগ্রন্থাগারের উন্নয়নে ধীরে ধীরে ডিজিটাল ক্যাটালগের কাজ করা হচ্ছে। প্রথম দিকে কাজে গতি থাকলেও করোনা ও অর্থাভাবে সংশ্লিষ্টদের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে কাজটি ধীরগতিতে চলছে। এছাড়া ভবন সংস্কার, নতুন আসবাবপত্র সংযোজন, বই কেনা, বইপাঠ প্রতিযোগিতা, সাহিত্য আলোচনা-আসর, তিন মাস পরপর সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
যশোর ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু উল্লেখ করেন, ‘আমাদের বেশকিছু বই কেনা হয়েছে। পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করতে সাহিত্যসভা, আবৃত্তিসহ নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছি।’
গ্রণগ্রন্থাগারটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রসঙ্গে যশোর ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু বলেন, ‘আমরা গণগ্রন্থাগারটির আধুনিকায়নে চারতলা ভবনের কাজ সম্পন্নের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠিয়েছি। এছাড়া যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গণগ্রন্থাগারকে ডিজিটালবান্ধব করতে আমাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ডিজিটাল লাইব্রেরির কাজ নতুনভাবে শুরু, লাইব্রেরিতে ইন্টারনেট-ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা চালুসহ ই-বুক করা।’