ইলিশের দেখা নেই, হতাশ জেলে ও ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ

ইলিশের দেখা নেই, হতাশ জেলে ও ব্যবসায়ীরা

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ভরা মৌসুমেও ইলিশের দেখা মিলছে না। ছোট আকারের হাতেগোনা যে ইলিশ নিয়ে জেলেরা ঘাটে ভিড়ছেন, তারও দাম আকাশছোঁয়া। এতে বিপাকে পড়েছেন জেলে ও ব্যবসায়ীরা। দফায় দফায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে সমুদ্রে যেতে পারছেন না বলে জানালেন জেলেরা।

মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, জুলাই থেকে অক্টোবর ইলিশের ভরা মৌসুম। প্রতি বছর এই সময়ে নদী ও সাগরে ধরা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। কিন্তু এ বছরের চিত্র অনেকটা ভিন্ন। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ২৩ জুলাই জেলেরা সাগরে নামলেও জালে ধরা পড়ছে না কাঙ্ক্ষিত বড় ইলিশ। এরই মধ্যে দফায় দফায় বৈরী আবহাওয়ায় সমুদ্র উত্তাল থাকার কারণে খালি হাতে ঘাটে ফিরতে হচ্ছে জেলেদের। ফলে চলতি মৌসুমে তেমন ইলিশ ধরতে পারেনি জেলেরা‌। এতে লোকসানে পড়তে হবে বলে জানালেন তারা।

সর্বশেষ রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকালে আলীপুর মৎস্যবন্দর ঘাটে ট্রলার নোঙর করে অনুকূল আবহাওয়ার অপেক্ষায় আছেন জেলেরা। যারা সমুদ্রে যাচ্ছেন তাদের অনেকে খালি হাতে ফিরছেন। কেউ বড় ইলিশের পরিবর্তে অল্প পরিমাণ জাটকা নিয়ে ফিরছেন। বড় ইলিশ কম পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়ছেন তারা।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা মৌসুমি বায়ু ও নিম্নচাপের প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল থাকায় উপকূলের জেলেরা ঘাটে বসে অলস সময় পার করেছেন। গত সোমবার শেষ বিকাল থেকে মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে হাজার হাজার মাছধরা ট্রলার গভীর সমুদ্রে ইলিশের সন্ধানে যায়। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়। তখন মাঝিরা ঘাটের উদ্দেশে ট্রলার নিয়ে রওনা হন। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাতাস কমে গেলেও মাছ কম থাকায় তারা ঘাটে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে শনিবার ও রবিবার অনেকে সমুদ্রে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন। বৈরী আবহাওয়া কেটে গেলে আবারও সমুদ্রে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তারা।

তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী দুই দিন উপকূলে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য গভীর সমুদ্রে যেতে জেলেদের নিষেধ করা হয়েছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন জেলেরা।

জেলেরা জানিয়েছেন, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। এবার মৌসুমের শুরুতেই সামুদ্রিক মাছ আহরণের ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা ছিল। এরপর দফায় দফায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে আশানুরূপ ইলিশের দেখা পাননি এখানকার জেলেরা। সব মিলিয়ে হতাশ হাজার হাজার জেলে। কেউ কেউ পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। আবার অনেকে দাদন নিয়ে বাধ্য হয়ে এই পেশাই পড়ে আছেন।

মাছ না পাওয়ার কথা জানিয়ে আলীপুরের জেলে জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘এবার যখনই সমুদ্রে নামি তখনই আবহাওয়া খারাপ। মাঝে দুদিন ছিলাম সমুদ্রে। মাছ তেমন পাই নাই। বড় ইলিশের দেখা নেই, ছোট কয়টা জাটকা পেয়েছি। বিক্রি করলে তাতে বাজার খরচ হয় না। মালিকের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছি। যদি সমুদ্রে মাছ পেতাম, তাহলে ধারদেনা শোধ করে সংসার চালাতে পারতাম। কিন্তু এবার মাছই পাচ্ছি না।’

মাছ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়ে কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর মৎস্যবন্দরের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন কাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সমুদ্রে শুরু হয়েছে দফায় দফায় নিম্নচাপ। যার ফলে ট্রলার নিয়ে বারবার সমুদ্রে গিয়ে খালি হাতে ঘাটে ফিরে আসছেন জেলেরা। ফিরে আসা ট্রলারগুলোর প্রত্যেকটিকে কয়েক লাখ টাকার বাজার করে সমুদ্রে পাঠাতে হয়। কিন্তু কখনও নিম্নচাপ কখনও লঘুচাপ; সব মিলিয়ে ইলিশ না পেয়ে খালি হাতে ফিরলে বড় রকমের ক্ষতির মধ্যে হচ্ছে আমাদের। এতে ট্রলার মালিকদের পাশাপাশি জেলেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এবার তেমন মাছ পাওয়া যায়নি।’

আলীপুরের এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের মাঝি ইউসুফ আলী বলেন, ‘এবার নিষেধাজ্ঞার পর এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখিনি‌। বাজার সদাই করে যখনই সমুদ্রে নামি, এক-দুদিন মাছ ধরার পরই আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। কোনও উপায় না পেয়ে ঘাটে ফিরে আসি। এভাবে চলতে থাকলে এই পেশা ছাড়তে হবে।’

মহিপুর আড়তদার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুমন দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শেষে এবার শুরু হয়েছিল সাগরে মাছ ধরা। মাঝে ২০-২২ দিন মাছ ধরার সুযোগ পেলেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাননি জেলেরা। মাছঘাটগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। যা কিছু ইলিশ নিয়ে জেলেরা ঘাটে ভিড়ছেন, তার দাম আকাশছোঁয়া। এবার মূলত ইলিশ কম থাকায় এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিপাকে পড়েছি আমরা।’

একই হতাশার কথা জানালেন আলীপুর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল জলিল ঘরামী। তিনি বলেন, ‘গত চার বছরে আমরা লাভের মুখ দেখিনি। তবু লাভের আশায় লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়ে জেলেদের সমুদ্রে পাঠাচ্ছি। কিন্তু ঘুরেফিরে হতাশ। এভাবে চলতে থাকলে পেশা টিকিয়ে রাখা যাবে না।’

সমুদ্রে ইলিশ না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র বার বার খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়ছে। ফলে গত কয়েক বছর আমরা দেখেছি, গভীর সমুদ্রে লম্বা জালে কিছু মাছের দেখা মিললেও ভাসান জাল, কালো কট বা লাল জালের অধিকাংশ জেলেরা তেমন ইলিশ পাচ্ছেন না। সমুদ্রের মোহনা খনন এবং সমুদ্রের ভেতরে ১২-১৪ কিলোমিটারে যে পলি বা চর পড়ে গেছে, তা খনন করতে হবে। সেই সঙ্গে মানুষের যে দূষণ, উপকূলবর্তী দূষণ, পলি ও রাসায়নিক দূষণরোধ করতে হবে। তবেই কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মিলবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। চেষ্টা করতেছি ইলিশের এই সংকট অবস্থা দূর করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। সে বিষয়ে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেবে বলেছে সরকার। আশা করছি, পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে গভীর সমুদ্রের সবখানে ইলিশ পাওয়া যাবে।’

Source link

Related posts

নেপালে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী পাঠাল বাংলাদেশ

News Desk

চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে লালখান বাজার রণক্ষেত্র, আহত ১০

News Desk

চুয়াডাঙ্গায় ২৪ ঘণ্টায় ৪ জনের মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment