এবার কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে এসেছেন অন্তত পাঁচ লাখ পর্যটক। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও বাংলা নববর্ষের টানা ছুটিতে ঘুরতে এসেছেন তারা। শুক্রবার (১২ এপ্রিল) সকাল থেকে বাড়তে শুরু করে পর্যটকের সংখ্যা। শনিবার (১৩ এপ্রিল) এই সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এতে জমে উঠেছে পর্যটককেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। তবে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে তাদের হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্টহাউজে জায়গা দিতে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। সবগুলো হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউজ এবং কটেজের কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে যাওয়ায় অনেকে ভোগান্তি পড়েছেন। কেউ কেউ একাধিক হোটেল ঘুরে কক্ষ না পেয়ে ফিরে গেছেন।
কক্সবাজারে পর্যটকের রাতযাপনের জন্য হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউজ ও কটেজ আছে সাড়ে পাঁচ শতাধিক। এসবে দৈনিক ধারণক্ষমতা এক লাখ ২৮ হাজার। শুক্রবার ও শনিবার; দুদিনে পাঁচ লাখ পর্যটক আসায় হোটেল-রিসোর্টে কক্ষ পাননি বেশিরভাগ। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্ভোগে পড়েন তারা।
কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত হোটেল ও গেস্টহাউজগুলোর ৯০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়েছিল। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ কক্ষ বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে বুকিং হয়ে যায়। ফলে শুক্রবার যারা এসেছেন; কক্ষ পাননি। এদিন অন্তত দুই লাখের বেশি পর্যটক এসেছেন। একইভাবে শনিবার আরও দুই লাখের বেশি পর্যটক আসেন। সবমিলিয়ে দুদিনে পাঁচ লাখের মতো পর্যটক আসায় অনেকে হোটেলের কক্ষ পাননি।
হোটেল মালিক ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত বছর ঈদের টানা পাঁচ দিনের ছুটিতে সৈকতে সাড়ে চার লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল। হোটেল-রেস্তোরাঁসহ নানা খাতে তখন ব্যবসা হয়েছিল হাজার কোটি টাকার। এবার চার লাখ পর্যটক সমাগমের আশা করেছিলেন তারা। কিন্তু তা ছাড়িয়ে গেছে। সৈকতের পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, টেকনাফ, রামু, চকরিয়া ও মহেশখালীর বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীর ভিড় বেড়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙাভাব ফিরেছে। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটকের সমাগম থাকবে। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
শনিবার বিকালে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে দেখা গেছে, পর্যটকের ঢল। সুগন্ধার দুই কিলোমিটার সৈকতে হাজারো পর্যটক। উত্তর দিকে সিগাল থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত দুই কিলোমিটারে ভিড় করেছেন আরও কয়েক হাজার পর্যটক। সুগন্ধার পূর্বদিকে কলাতলী সৈকতের এক কিলোমিটারে আছেন আরও কয়েক হাজার। এর মধ্যে অনেকে সৈকতে গোসলে নেমেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে মেতেছেন আরও অনেকে। সবমিলিয়ে সৈকতজুড়ে দেড় থেকে দুই লাখ পর্যটক দেখা গেছে।
মূলত ঈদের পরদিন থেকে পর্যটকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে জানালেন কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ রোড হোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মৌখিম খান। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত গরমের কারণে ঈদের আগে পর্যটকশূন্য ছিল কক্সবাজার। ঈদের প্রথমদিনেও তেমন সমাগম ছিল না। কিন্তু ঈদের পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে পর্যটন সমাগম দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ এর আগের দিনই হোটেল-মোটেলের শতভাগ কক্ষ বুকিং হয়ে গিয়েছিল। কোনও হোটেলে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ পাইনি। যদি অভিযোগ পাই এবং ওই হোটেল আমাদের সমিতিভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেবো।’
বিপুলসংখ্যক পর্যটকের খাবারের চাহিদা মেটাতে বন্ধ থাকা সাত শতাধিক রেস্তোরাঁ খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ডালিম। তিনি বলেন, ‘রোজার মাসে অধিকাংশ হোটেল-রেস্তারাঁর সংস্কারকাজ হয়েছে, অনেকগুলো বন্ধ ছিল। তবে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। সবগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের কাছ থেকে খাবারের অতিরিক্ত মূল্য আদায় হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খাবার টেবিলে মূল্যতালিকা রাখা থাকে। কাজেই বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই।’
ঈদের আগে থেকেই পর্যটক বরণে প্রস্তুত ছিলাম জানিয়ে রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘এবার চার লাখ পর্যটকের সমাগম হবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। শুক্রবার থেকে পর্যটক এসেছেন। তাদের সর্বোচ্চ সার্ভিস দিচ্ছি। খাবারের অতিরিক্ত দাম কোথাও রাখা হচ্ছে না। যদি এমন হয় তাহলে প্রতিটি রেস্টুরেন্টে আমাদের মোবাইল নম্বর আছে। ফোন করে অভিযোগ জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ইনানীর পাটোয়ারটেক পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে আসা মিনহাজুল আলম বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে এসে কোনও হোটেলে কক্ষ পাইনি। ভোগান্তিতে পড়েছি। যেখানে গেছে, সেখানেই বলেছে কক্ষ নেই। কয়েক লাখ পর্যটক এসেছেন। সবাই এই সমুদ্রসৈকত ছাড়া কিছু কল্পনা করতে পারে না। অথচ এই সৈকত ছাড়াও অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। সেগুলোতে ঘুরেছি আমরা। আর আসবো না।’
গাজীপুর থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসা সরকারি কর্মকর্তা জেসমিন ফারিয়া বলেন, ‘কক্সবাজারে যতবার আসি, ততবারই এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করে। মন খারাপ থাকলে কিংবা লম্বা ছুটি পেলেই পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসি। এবার আব্বা-আম্মা, বড় ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এলাম। তবে প্রচুর পর্যটক এসেছেন। অনেকে হোটেলে কক্ষ না পেয়ে ফিরে গেছেন। এর আগে যতবার এসেছি, এত পর্যটক দেখিনি।’
এদিকে, অনেকে হোটেলে কক্ষ না পেয়ে মহেশখালীর ঐতিহ্যবাহী আদিনাথ মন্দির দেখতে গেছেন। কেউ কেউ মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় ঘুরেছেন। তবে ভেতরে ঢোকার অনুমতি না থাকায় সমুদ্রসৈকত থেকে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখছেন তারা। এছাড়া সাবরাং ট্যুরিজম স্পট, শামরাপুর নানা রঙের সাম্পানের সৈকত, জাহাজপুরা শতবর্ষী গর্জন ট্যুরিজম স্পটে ঘুরেছেন পর্যটকরা।
পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং হয়রানিরোধে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ রিজিয়নের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আপেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা এবং সেবা দিতে সৈকত ছাড়াও অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রে ট্যুরিস্ট পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যটকদের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করেছি আমরা। যেকোনো সমস্যায় পড়ে পর্যটকরা একটি বাটন চাপলেই আমাদের সেবা পাবেন।’
অতিরিক্ত হোটেল ভাড়া এবং খাবারের মূল্য বাড়িয়ে আদায় হচ্ছে কিনা, তা তদারকির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামানো হয়েছে বলে জানালেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে থেকে আশা করছিলাম পর্যটকে মুখরিত হবে কক্সবাজার। তা ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকেই দেখা গেছে। তাদের সেবা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসন সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। হোটেলে-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় অতিরিক্ত টাকা আদায়, পর্যটকদের হয়রানি বন্ধসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমুদ্রসৈকত এবং আশপাশের বিনোদনকেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে। ভ্রমণ শেষে পর্যটকরা নিরাপদে ঘরে ফিরুক এটাই আমাদের চাওয়া।’