চট্টগ্রামে ব্যস্ততা বেড়েছে ঝাউতলা বিহারি পল্লির বুটিক হাউসগুলোতে। এখানে ছোট-বড় ৩৫টি বুটিক হাউসে কর্মরত আড়াই শতাধিক কারিগর। তারা দিনরাত সমানতালে কাজ করছেন। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে তাদের ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে। থান কাপড়ের ওপর পুঁতি, পাথর ও চুমকি বসিয়ে তৈরি করছেন নানা ডিজাইনের বাহারি শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস, পাঞ্জাবিসহ অন্যান্য পোশাক।
খুলশী থানার ঝাউতলা বিহারি পল্লিতে দেখা গেছে, বুটিক হাউসগুলোতে কর্মরত কারিগরদের মাথা তোলার সময় নেই। জর্জেট, শিফন, টিস্যু, সিল্ক ও বেলবেট কাপড়ের ওপর তারা সুই-সুতার সাহায্যে পুঁতি, জড়ি, স্প্রিং ও চুমকি দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বুটিক হাউসগুলোর স্বত্বাধিকারীরা বলছেন, রমজান মাসে বিহারি পল্লির বুটিক হাউসগুলোতে গড়ে চার লাখ টাকা করে কাজের অর্ডার পাওয়া গেছে। সে হিসাবে বিহারি পল্লির ৩৫টি বুটিক হাউসে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা বিক্রির লক্ষ্য রয়েছে।
ঝাউতলাবাজার স্কুল ক্যাম্প রোড এলাকায় অবস্থিত আনুশা বুটিক। এই বুটিকের মালিক মোহাম্মদ শহিদ। তিনি বলেন, ‘ঈদ ঘিরে কাজের অর্ডার অনেক বেড়েছে। এজন্য আমাদের দিনরাত কাজ করতে হয়। এখানে নকশায় যেসব পুঁতি, জরি, স্প্রিং ও চুমকিসহ নানা উপকরণ ব্যবহার হয় তা ঢাকা থেকে কিনে আনতে হয়। মূলত এসব উপাদান ভারত থেকে আমদানি করা।’
তিনি বলেন, ‘কাজ অনুযায়ী আমরা পারিশ্রমিক নিই। কোনও কোনও থ্রিপিসে কাজ অনুয়ায়ী দুই থেকে তিন হাজার টাকা নিই। আবার লেহেঙ্গা-বিয়ের শাড়িতে ১০ থেকে ১৫ হাজার কিংবা আরও বেশি নিই। দেশের বিভিন্ন বড় বড় শোরুম এখানে কাজের অর্ডার দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ না থাকায় অনেকে দোকান ভাড়াসহ কর্মচারীদের বেতন দিতে না পারায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার অনেকে বুটিকের কাজ বাদ দিয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। এজন্য বুটিক হাউস কমেছে।’
আনুশা বুটিকে কাজ করছেন সাত জন কারিগর। এর মধ্যে কারিগর মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এখানে কর্মরতদের সবাই ঝাউতলা এলাকার বিহারি পল্লির বাসিন্দা। ১৩ বছর বয়সে বুটিকের কাজ শুরু করেছি। বাবা মোজাফ্ফরের কাছ থেকে কাজ শিখেছি। এখন আমার বয়স ২৬ বছর। ১৩ বছর ধরে এই কাজ করছি।’
মোস্তফা বলেন, ‘এখানে কর্মরতরা কাজের দক্ষতার ওপর মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান। এ দিয়ে চলে সবার সংসার।’
আনুশা বুটিকে কর্মরত ইশতিয়াক, আবির, রাশেদ, হোসেন, মো. হিরা, মো. রুবেল জানান, একটি পোশাক তৈরিতে কত সময় লাগবে তা নির্ভর করে কাজের ওপর। এর মধ্যে কোনও কোনও পোশাকের কাজ একদিনেই হয়ে যায়। আবার কখনও কখনও পোশাক তৈরিতে এক সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। বিশেষ করে বিয়ের শাড়ি ও লেহেঙ্গায় সময় বেশি লাগে।’
আনুশা বুটিকের পাশেই পাপ্পু বুটিক, রাজু বুটিক, জালাল বুটিক, জনি বুটিক, রাহুল বুটিক, আরজু বুটিক, চুন্নু বুটিকসহ ৩৫টি বুটিক হাউস।
রাজু বুটিক হাউসে দেখা গেছে, কারিগররা কেউ কাপড় কেটে দিচ্ছেন, কেউ সেই কাপড়ে নকশা আঁকছেন। কেউ নকশার ওপর পুঁতি ও স্প্রিং বসাচ্ছেন।
এই প্রতিষ্ঠানের কারিগর মিনারুল হোসেন বলেন, ‘ঈদের কারণে অর্ডার বেড়েছে। অর্ডার নেওয়া কাপড় সময়মতো ডেলিভারি দিতে হবে। এজন্য আমাদের দিনরাত সমানতালে কাজ করতে হয়।’
জনি বুটিক হাউসে দেখা গেছে, সেখানেও ব্যস্ত কারিগররা। তাদের নিপুণ হাতে প্রতিটি কাপড় হয়ে উঠছে আকর্ষণীয়।
এখানকার কারিগর রুবেল হোসেন বলেন, ‘এখানকার তৈরি নানা ডিজাইনের শাড়ি, থ্রিপিস, লেহেঙ্গা ও পাঞ্জাবিসহ কারুকাজ সজ্জিত পোশাক বিক্রি হয় চট্টগ্রামসহ নামিদামি দোকানগুলোতে। চট্টগ্রামের নিউমার্কেট, মিমি সুপার মার্কেট, আফমি প্লাজা, লাকি প্লাজা, আমিন সেন্টারসহ বড় বড় মার্কেটের শোরুম এখান থেকে শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস বানিয়ে নেয়। শুধু চট্টগ্রাম নয়, এসব কাপড় বিক্রি হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শোরুমে।’
ঝাউতলা বিহারি পল্লির বাসিন্দা নুরুল হক বলেন, ‘একসময় ঝাউতলায় বুটিক হাউস আরও বেশি ছিল। এখানকার কারিগরদের বানানো কাপড়ের আকর্ষণ অনেক বেশি ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানের নামিদামি শোরুম থেকে কাপড়ের অর্ডার আসতো। কিন্তু বাজারে ভারতীয় কাপড়ের আধিপত্যের কারণে ঝাউতলার বুটিক হাউসগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানকার কাপড়ের নকশায় যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয় তা মূলত ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ঝাউতলার বিহারি পল্লিতে অন্তত ১০-১৫ হাজার বিহারি রয়েছেন। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশে আটকা পড়েন। সুই-সুতার কাজ তাদের পুরনো পেশা। এখানে আগে অনেক বেশি বুটিক হাউস ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে অনেক কমে গেছে। আগে ঝাউতলা বুটিক হাউসগুলো ছিল সারাদেশের বড় বড় শোরুমের চাহিদার শীর্ষে। তারা এখান থেকে কাপড়ে ডিজাইন করে নিতো। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে কাপড় আমদানি হচ্ছে। দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান মেশিনের সাহায্যে কাপড়ে নকশার কাজ করছে। এজন্য ঝাউতলার বিহারি পল্লির কাজের গতি কমেছে। তবে ঈদ ঘিরে তাদের কাজ বেড়ে গেছে।’