ভাটার সময় প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে জমির পরিমাণ আট বর্গকিলোমিটার আর জোয়ারের সময় পাঁচ বর্গকিলোমিটার। সেই জমিতে অবৈধভাবে হোটেল-মোটেল নির্মাণ করছেন প্রভাবশালীরা। এবার নতুন করে সৈকতের পাশে মার্কেট নির্মাণ করেছেন এক ইউপি সদস্য (মেম্বার)। তিন-চার মাস আগে সৈকতের পাশের স্থাপনাগুলো উপজেলা প্রশাসন উচ্ছেদ করলেও এখন আবার দখলে নিয়েছেন অনেকে। দখলের ফলে দিন দিন কমছে সৈকতের পরিমাণ। এতে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সৈকত, হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, উচ্ছেদকৃত জায়গাগুলো আবারও দখল হয়ে গেছে। সেখানে দোকানপাট ও মার্কেট করে ভাড়া দিয়েছেন অনেকে। এতে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
সেন্টমার্টিন জেটিঘাটের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে দেখা গেছে, সৈকতের আশপাশ দখল করে অর্ধশতাধিক দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছিল। মৌসুম শুরু হওয়ার পরই সেখানে এসব দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যদিও এর আগে কয়েক দফায় উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেগুলো আবারও দখল হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আর্থিক সুবিধা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছেন প্রভাবশালীদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেন্টমার্টিন জেটিঘাটের কাছাকাছি বাজারপাড়ার দক্ষিণে সৈকতের জমি দখল করে মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে। এর নাম ‘নোমান মার্কেট’। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্কেটের অধিকাংশ দোকান স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আল নোমান এবং তার ভাই ইমাম হোসেনের। পাশাপাশি সৈকতের পাড়ে আরও দোকানপাট তৈরি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. মতলব, মোহাম্মদ উল্লাহ, মনি উল্লাহ ও আবদুল গণিসহ অনেকে। ইতোমধ্যে দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছেন তারা। সেখানে ব্যবসা করছেন অনেকে।
বাজারপাড়া এলাকায় সৈকতের তীরে নির্মিত নোমান মার্কেটের একটি দোকানে ‘তাজা রেস্টুরেন্ট’ নামে সাইনবোর্ড ঝুলছে। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আবদুর শুক্কুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে আমার এবং মেম্বারের ভাই ইমাম হোসেনের একাধিক দোকান আছে। নোমান মার্কেটের তিনটি দোকান ভেঙে বড় করে রেস্টুরেন্ট করেছি। ইমাম হোসেনের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা করছি। আমাদের পাশের দোকানগুলো মেম্বারের।’
সরকারি জমিতে কীভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুর শুক্কুর বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ব্যবসা করতে হয়। সবাই তাই করছে।’
সেন্টমার্টিন জেটিঘাট সংলগ্ন দক্ষিণ বাজার ও পূর্ব বাজার এলাকাটি সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) হিসেবে আছেন মো. আল নোমান। প্রভাব খাটিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সৈকতের সরকারি জমিতে মার্কেট করেছেন। একইসঙ্গে নিজের স্বজনদের দোকানপাট নির্মাণে সহায়তা করেছেন। তাকে দেখে অন্যরাও সেখানে দোকানপাট গড়েছেন।
ইমাম হোসেন বলেন, ‘এখানে আমার সাতটি দোকান রয়েছে। আমার ভাইয়েরও কিছু দোকান আছে। চুক্তির মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা জামানত নিয়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছি। কয়েকটিতে নিজেরাই ব্যবসা করছি। কোনোটি খালি নেই। সবগুলো ভাড়া হয়ে গেছে। দোকানগুলো আমাদের নিজস্ব জমিতে নির্মাণ করেছি।’
সরকারি জমি কীভাবে নিজেদের বলে দাবি করছেন জানতে চাইলে ইমাম হোসেন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে সৈকতের পাড়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছি। এগুলো সৈকতের জমি হলেও আমাদের দাবি আছে। এখন সরকার দেখভাল করে। তবে আমরা লিজ নিইনি। এখানে এভাবে ব্যবসা করছে সবাই, আমরাও করছি।’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই অংশ হিসেবে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনাসহ ১৩টি সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সেসময় সৈকতের পাড়ে ও সেন্টমার্টিন জেটিঘাট সংলগ্ন দক্ষিণ বাজার, পূর্ব বাজারে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট, ফিশারিসহ ৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু সেখানে ইতোমধ্যে আবারও একই ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
সৈকতে মার্কেট নির্মাণের কথা স্বীকার করে সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আল নোমান বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে আমরা সৈকতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছি। এটা সত্য যে, ২০২২ সালে সৈকতের আশপাশের দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়েছিল। উচ্ছেদের পর উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে মার্কেটটি নির্মাণ করেছি। সেখানে কয়েকটি দোকানপাট আছে আমার।’
জনপ্রতিনিধি হয়েও সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে সরকারি জমিতে মার্কেট নির্মাণ কতটুকু যৌক্তিক এমন প্রশ্নের জবাবে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘শুধু আমি না, সৈকতের জমি দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে অনেকে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন করে অনেকে দোকানপাট নির্মাণ করছেন। বিষয়টি আমি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।’
সৈকতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আদনান চৌধুরী বলেন, ‘সৈকতের আশপাশে গড়ে উঠা অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদে দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান চালাবে উপজেলা প্রশাসন। কে জনপ্রতিনিধি, কে প্রভাবশালী, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কয়েকদিনের মধ্যে দ্বীপের জরিপ করবো। কেউ সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘ইতিপূর্বে আমরা প্রবাল দ্বীপের অনেক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করেছি। দ্বীপ বাঁচলে আমাদের পর্যটন শিল্প থাকবে। প্রবাল দ্বীপ রক্ষায় সরকারকে কঠোর আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘আমরা অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবো। সৈকতের আশপাশে কারও দোকানপাট নির্মাণের সুযোগ নেই। যারাই নির্মাণ করেছেন, সব উচ্ছেদ করা হবে।’