কেউ ট্রলার মেরামতের কাজ সেরেছেন, কেউ ট্রলারে রঙ করেছেন, কেউ ধোয়ামোছা শেষ করেছেন, অনেকে নতুন জাল বুনেছেন, আবার কেউ সব সরঞ্জাম প্রস্তুত করে রেখেছেন। এভাবেই মাছ ধরার প্রস্তুতি নিয়েছেন কুয়াকাটার জেলেরা। মা ইলিশ সংরক্ষণে নদী ও সাগরে ইলিশ শিকারে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ রবিবার। এদিন মধ্যরাত থেকে জেলেরা ইলিশ ধরতে নামবেন। ইতিমধ্যে জাল, ট্রলার, নৌকাসহ মাছ ধরার সরঞ্জাম মেরামত করে সব প্রস্তুতি সেরেছেন তারা। এখন শুধু অপেক্ষা নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা শেষ হওয়ার।
জানা গেছে, প্রজনন মৌসুমে ইলিশের বংশবিস্তার নির্বিঘ্ন করতে গত ১৩ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের এই নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়। জেলেসহ মৎস্যজীবীদের আশা, এবার তাদের জালে ধরা পড়বে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। তবে নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে সরকারি প্রণোদনার চাল অনেক জেলে পাননি বলে দাবি তাদের। এ ছাড়া মৌসুম জুড়ে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরা না পড়ায় ২২ দিনে কর্মহীন অনেক জেলে ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২২ দিনের অবরোধ সফল করতে তৎপর ছিলেন মৎস্য বিভাগসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সাগর ও নদীতে অভিযান চালিয়ে অনেক জেলেকে জরিমানা ও কারাদণ্ড দিয়েছে মৎস্য বিভাগ। তাই সাগরে গিয়ে এবার ধরা পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ এমনটি প্রত্যাশা মৎস্য বিভাগের।
কলাপাড়া উপজেলার গঙ্গামতি এলাকার জেলে মমিন উদ্দিন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা মেনে আমরা ২২ দিন কর্মহীন সময় পার করেছি। আমাদের মাত্র ২৫ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। পরিবারের পাঁচ জন্য সদস্য। এই চাল দিয়ে কিছুই হয়নি। আট হাজার টাকার মতো দেনায় পড়েছি। তবে এই চাল সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।’
আলীপুরের জেলে একলাস গাজী বলেন, ‘সরকারি তালিকায় প্রকৃত অনেক জেলের নাম নেই। যাদের অন্য পেশায় জড়িত দেখেছি তারা সরকারি চাল পেয়েছে। তাই অনেক প্রকৃত জেলে চাল পায়নি।’
আরেক জেলে আলী হোসেন বলেন, ‘রবিবার মধ্যরাতে আমরা গভীর সাগরে যাত্রা করবো। তাই ট্রলারে জাল ও বরফসহ সব সরঞ্জাম তুলেছি। আমাদের ট্রলারের রঙ করার কাজ শেষ হয়েছে।’
উপজেলা মৎস্য অফিস জানায়, কলাপাড়ায় নিবন্ধিত ১৮ হাজার ৩০৭ জেলে রয়েছেন। অবরোধ চলাকালে প্রত্যেককে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এবার অবরোধ শতভাগ সফল করতে সাগর ও নদীতে উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌ-বাহিনী অভিযান পরিচালনা করেছে।
কলাপাড়া উপজেলা ফিশিং ট্রলার মাঝি সমবায় সমিতির সভাপতি মান্নান মাঝি বলেন, ‘জেলেরা ঠিকমতো নিষেধাজ্ঞা পালন করেছেন। প্রশাসন অনেক ভারতীয় জেলেকে আটক করেছে। আশা করছি, নিষেধাজ্ঞা ঠিকমতো পালন হওয়ায় এবার কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মাছ ধরা পড়বে। সাগরে কাঙ্ক্ষিত মাছ পেলে পেছনের ধারদেনা কাটিয়ে উঠতে পারবেন জেলেরা। ইতিমধ্যে আমরা সাগরে যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার শেষের দিকে গভীর সমুদ্র থেকে নদীর মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। তাই ২০০৬ সাল থেকে মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিন অবরোধ দিয়ে আসছে সরকার। এ সময় সব ধরনের মাছ শিকার, পরিবহন, মজুত, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য অধিদফতর। এবার প্রশাসনের তৎপরতা বেশি থাকায় উপকূলজুড়ে মাছ ধরা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। জলসীমানায় ঢুকে মাছ শিকারের সময় ভারতীয় জেলেদের আটক করা হয়েছে। এজন্য প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলেরা।
মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. ফজলু গাজী বলেন, ‘যেহেতু অবরোধের আগে মাছ ধরা পড়েনি তাই আমরা আশা করছি, অবরোধ শেষে বড় সাইজের পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা মিলবে।’
কলাপাড়ার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘উপকূলের জেলেরা নিজেরাই অনেকটা সচেতন হয়েছেন। আমরা এ পর্যন্ত যৌথ অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দেশীয় জেলেদের পাশাপাশি ভারতীয় জেলেদের জরিমানা এবং ট্রলার জব্দ করেছি। দিন-রাত মা ইলিশ রক্ষায় কাজ করেছি। আশা করছি, এ বছর শতভাগ সফল হয়েছি। কারণ গত পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হলে সব ডিমওয়ালা মা মাছ দ্রুত ডিম ছেড়ে দেয়। সে হিসেবে এবার মাছের পরিমাণ বাড়বে।’