নিজের ‘সবশেষ ব্রিফিংয়ে’ বরাবরের মতো লিখিত বক্তব্য দিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। আজ সোমবার বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাসহ অন্যরা। তবে সেখানে মাহবুব তালুকদার থাকেননি। অবশ্য এর কারণ পরে বলেছেন। কমিশনের সংবাদ সম্মেলনের পর লিখিত বক্তব্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচন—ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে নিজের কথাগুলো বলেছেন ‘আমার কথা’ শিরোনামে লিখিত বক্তব্যে।
মাহবুব তালুকদার বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে কথা বলা অমূলক। মানবাধিকার নেই, মানবিক মর্যাদা নেই, গণতন্ত্র না থাকলে এসব থাকে না। বিশ্বে সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে আসীন হতে হলে গণতন্ত্রের শর্তগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে। ভোটাধিকার ও মানবাধিকার একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে এর উৎপত্তি।
মাহবুব তালুকদার বলেন, বর্তমান অবস্থায় উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আইনপ্রণেতারা আইন প্রণয়নের চেয়ে উন্নয়নেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু উন্নয়ন কখনো গণতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থা নয়। সম্প্রতি শেষ হলো ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমেই এ কমিশনের নির্বাচন পর্ব শেষ হলো।
মাহবুব তালুকদার সেই নির্বাচন নিয়ে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে ওই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? কথাটা রূপকার্থে বলা হলেও—এটাই সত্য। নির্বাচনের নামে সারা দেশে এমন অরাজকতা কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তৃণমূল পর্যায়ে এই নির্বাচন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচন বলা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’
বিদায়ের সময় আত্মবিশ্লেষণ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বড় দুর্বলতা নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি ইত্যাদি সম্পর্কে ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা যেসব অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। লিখিতভাবে যেসব অভিযোগ পাঠানো হয়, তারও যথাযথ নিষ্পত্তি হয় না। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না নিয়ে নথিভুক্ত করা হয় বা অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁইও হয় না। আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে এসে গত কয়েক মাসে অবশ্য এর কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে।’
নির্বাচন নিয়ে নানা সময়ে নিজের মন্তব্য এবং এর ফলাফল নিয়েও কথা বলেন মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে গত পাঁচ বছরে যা কিছু বলেছি, তাতে কোনো ফলোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। আগেও বলেছি, নির্বাচন কমিশন গঠন আইন বাধ্যতামূলক। তবে আইনটি সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সংকটের সমাধান হবে না। এখন পর্যন্ত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের কোনো পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে না। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি সব সংকটের সমাধান দেখতে চাই।’
নির্বাচনে জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অপরিহার্য বলে মনে করেন মাহবুব তালুকদার। এ প্রসঙ্গে তাঁর কথা, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অনুপস্থিত। এতে বিশেষভাবে টাকার খেলাই প্রতিভাত হয়। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন, আইনপ্রণেতারা ভবিষ্যতে আইন–ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন না তো? অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাবিঘ্নগুলো দূর করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য সংবিধান ও বিধিবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে।’
আলাদা করে সংবাদ সম্মেলন কেন—এ প্রশ্নের জবাবে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘বিশেষ কোনো কারণ নেই। এখানে মুক্তভাবে কথা বলতে পারছি। সেখানে হয়তো সেটা সম্ভব হতো না।’