উপকূলের ঘরে ঘরে বিষাক্ত অ্যাসবেসটস
বাংলাদেশ

উপকূলের ঘরে ঘরে বিষাক্ত অ্যাসবেসটস

সাতক্ষীরা উপকূলের অধিকাংশ ঘরের চালে ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত অ্যাসবেসটস। টিনের বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। বৃষ্টির সময় অ্যাসবেসটসের ছাউনিতে পড়া পানি সংরক্ষণ করে তা পান করা হয়। এতে ক্যানসার ও অ্যাসবেসটোসিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন উপকূলের মানুষ।

শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক হাফিজুল ইসলাম (৩৫) ১৩ বছর ধরে অ্যাসবেসটস দিয়ে তৈরি ছাউনি ঘরের চালে ব্যবহার করছেন। সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে বৃষ্টির সময় চালের পানি ধরে রেখে তা পান করেন। তিন বছর আগে শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা ও শরীর জ্বালাপোড়া দেখা দেয়। দিন দিন শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারেন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। গত দুই মাস ধরে ভারতের ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনটি কেমোথেরাপি নিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে তার।

তার মতো ১০ বছর ধরে অ্যাসবেসটস দিয়ে তৈরি ঘরের ছাউনি ব্যবহার করছেন গাবুরার গাইনবাড়ির বাসিন্দা মাসুদুল আলম (৩০)। অ্যাসবেস্টসের চালের পানি ধরে রেখে তা পান করতেন তিনিও। পিত্তথলির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল মারা গেছেন মাসুদুল।

সরেজমিন দেখা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, প্রতাপনগর, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, রমজাননগর, কৈখালি এবং ইশ্বরীপুরসহ উপকূলীয় বহু ঘরে অ্যাসবেসটসের তৈরি ছাউনি ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু চালে নয়, অনেকের ঘরের বেড়াও অ্যাসবেসটসের তৈরি।

স্কুলশিক্ষক হাফিজুল ইসলামের স্ত্রী আফরোজা খাতুন বলেন, ‘দুই মাস আগে ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছে স্বামীর। বর্তমানে ভারতের ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনটি কেমো দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী বিড়ি-সিগারেট পান করেন না। ১৩ বছর ধরে ঘরের চালে অ্যাসবেসটসের তৈরি ছাউনি ব্যবহার করছি। ভারতের চিকিৎসকরা স্বামীর কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়েছেন, যেমন বিড়ি-সিগারেট পান করেন কিনা। কোথায় থেকে পানি পান করেন। একপর্যায়ে তিনি চিকিৎসকদের জানান, বৃষ্টির সময় অ্যাসবেসটসের তৈরি ঘরের চালের পানি সংরক্ষণ করে তা পান করেন। তখন চিকিৎসকরা বলেন, অ্যাসবেসটসের চালের পানির সঙ্গে কেমিক্যাল গিয়ে ফুসফুস ক্যানসার হয়েছে তার।’

চিকিৎসকরা বলছেন, খনিজ তন্তু অ্যাসবেসটস শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ অ্যাসবেসটোসিস ও ক্যানসারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। এ উপাদান মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সেইসঙ্গে পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর।

একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অ্যাসবেসটস ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক উঠে এসেছে। অ্যাসবেসটসের ঘরের ছাউনি ব্যবহার সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এটি মরণব্যাধি ক্যানসারের কারণ।

অ্যাসবেসটস কী?

অ্যাসবেসটস প্রাকৃতিকভাবে তৈরি সিলিকেট খনিজের সম্মিলিত নাম। এর মধ্যে আছে গ্রুনেরাইট, অ্যানথোফিলাইট, অ্যান্টিনোলাইট এবং ক্রিসোটাইল। দীর্ঘস্থায়ী এবং অগ্নি প্রতিরোধক হওয়ায় এই তন্তুময় উপাদান নির্মাণ এবং শিল্প খাতে বেশ জনপ্রিয়। এটি সিমেন্টের সঙ্গে বেশ সহজেই মিশে যায়।

যে ধরনের ক্ষতি করে অ্যাসবেসটস

অ্যাসবেসটস আঁশের দীর্ঘায়িত শ্বসন ফুসফুস ক্যানসার, মেসোথেলিয়মা এবং অ্যাসবেসটোসিস রোগে আক্রান্ত করে। অ্যাসবেসটসের সব প্রকার নিষ্কাশন, উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

শুধু চালে নয়, অনেকের ঘরের বেড়াও অ্যাসবেসটসের তৈরি

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘অ্যাসবেসটস খনি থেকে সংগ্রহ করা হয়। অ্যাসবেসটস ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং সিলিকার সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক কণিকা। এটি শিল্প কারখানা, জাহাজ নির্মাণ, বিমান উৎপাদন এবং বিভিন্ন জায়গায় টিনের বিকল্প ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘বন্যাকবলিত এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় টিনের বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন খনি থেকে অ্যাসবেসটস বেশি উত্তোলন করা হয়। কানাডার ক্যুবেক প্রদেশের অ্যাসবেসটস শহরের জেফ্রি খনি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অ্যাসবেসটস খনি ছিল। ১৯৫০ সালের পর থেকে অ্যাসবেসটসের ক্ষতিকর দিকগুলো সবার সামনে আসে। এটি ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশে ২০০৫ সাল থেকে এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাড়িঘর তৈরির কাজেও অ্যাসবেসটস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও কানাডায় এখনও অ্যাসবেসটস উৎপাদন হচ্ছে।’

যেভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে অ্যাসবেসটস

অ্যাসবেসটস ফাইবারের মাধ্যমে নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। অ্যাসবেসটসের ধুলিকণা ফুসফুসে রোগের সৃষ্টি করে। এটি বেশি সময় শরীরের মধ্যে অবস্থান করায় ফুসফুস ক্যানসার কিংবা পাকস্থলীর ক্যানসার হয়। প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়।’

কাজী আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘উপকূলের মানুষ অ্যাসবেসটস দিয়ে তৈরি চালের পানি পান করছেন। এই পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। তাহলে বোঝা যাবে মাত্রাটা কি পরিমাণ ছড়াচ্ছে, কোন পর্যায়ে আছে। মানুষের শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর, কত মানুষ আক্রান্ত তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। বাতাসে এ খনিজের কণাও ক্ষতিকর। পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। সেজন্য দেশে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় ৩০টি দেশ অ্যাসবেসটস ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার মানুষ অ্যাসবেসটসজনিত কারণে ফুসফুস ক্যানসার, মেসোথেলিয়মা ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন জানিয়েছে, অ্যাসবেসটসের কোনও নিরাপদ স্তর নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, অ্যাসবেসটস শ্বসনতন্ত্র রোগীদের ২০ শতাংশের ক্যানসার ঘটায়।’

এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল ঘরের চালে ছাউনি হিসেবে অ্যাসবেসটস বাংলাদেশে ব্যবহার হয় না। যতটুক জানি এটি আমদানি নিষিদ্ধ। একটি বেসরকারি সংস্থা আমার কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল, অ্যাসবেসটস নিয়ে তো অনেক কথা হচ্ছে, সেটা বিতরণ করা ঠিক হবে কিনা। পরে একদিন দেখলাম, ভ্যানে কিছু অ্যাসবেসটস ছাউনি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন জানতে পারি দেশে অ্যাসবেসটস ব্যবহার হয়।’

গবেষণায় অ্যাসবেসটস ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক উঠে এসেছে

তিনি বলেন, ‘অ্যাসবেসটস স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি ফাইবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরের প্রবেশ করে। এতে পাকস্থলীর ক্যানসার হয়। উপকূলের মানুষ যদি অ্যাসবেসটস চালের পানি ধরে তা পান করেন তাহলে ক্যানসার হওয়া স্বাভাবিক। এটি দুশ্চিন্তার বিষয়। বিভিন্ন কোম্পানি টিনের বিকল্প হিসেবে যে অ্যাসবেসটস বিক্রি করছে, সেটিতে কী পরিমাণ অ্যাসবেসটস আছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি।’

গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া এলাকার মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগে ঘরের চালে গোলপাতা আর খড় ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন গোলপাতা কিংবা খড় নেই বললেই চলে। অনেকে ঘরের চালে টিন ব্যবহার করেন। কিন্তু উপকূলের মানুষের জন্য শুষ্ক মৌসুমে তাপদাহে টিনের ঘরে থাকা কষ্টকর। এক-দুই বছরের বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায় টিন। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এ এলাকা গাছপালাশূন্য। এসব কারণে আমরা অ্যাসবেসটসের ছাউনি ব্যবহার করছি। সেইসঙ্গে বৃষ্টির সময় পানি ধরে তা পান করছি। কিন্তু এটি যে ক্যানসারের কারণ তা আমাদের জানা ছিল না।’

শ্যামনগর সদরের মরিয়ম অ্যাসবেসটস শিটের ডিলার আরিফুজ্জামান মাসুম বলেন, ‘আগে মানুষ গোলপাতা এবং খড় ব্যবহার করতেন। কিন্তু সেটি দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় এখন কম দামে বেশি টেকসই অ্যাসবেসটস শিট ব্যবহার করছেন। এতে ক্ষতিকর কিছু আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে রোদে এটি প্রচণ্ড গরম হয়। আবার দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু অ্যাসবেসটস শিটের পানি পানে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে, তা আমার জানা ছিল না। এ বিষয়ে আমরা মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।’

Source link

Related posts

জামালপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আ.লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ

News Desk

গাজীপুরে দার্জিলিং কমলা চাষে চমক

News Desk

এক শিক্ষার্থীকে পরপর ৪ ডোজ টিকা, তদন্ত কমিটি গঠন

News Desk

Leave a Comment