চারদিকে নদী ও সুন্দরবন ঘেরা খুলনার উপকূলের মানুষজন একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। উপকূলের মানুষের কাছে সবচেয়ে ভয়াল মে মাস। তাদের কাছে এটি আতঙ্কের নাম। গত কয়েক বছর যে ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হেনেছে, অধিকাংশই মে মাসে। এখন ঘূর্ণিঝড়ের খবর শুনলেই আতঙ্কে দিন কাটে তাদের। প্রতি বছর দুর্যোগের পর নতুন করে ঘর বাঁধেন, বছর না ঘুরতেই আবার ঘরবাড়ি হারানোর আতঙ্ক। এই ভাঙা-গড়ার যন্ত্রণার মাঝে আবারও মে মাসে আসছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি শনিবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় রিমালে পরিণত হয়। এতে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েন খুলনা উপকূলের মানুষ। কারণ উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের দুই হাজার ছয় কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর আগের বছরগুলোতে নিজেদের রক্ষা করতে পারলেও বসতঘর, ফসলি জমি, গবাদি পশু, মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন তারা।
উপকূলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা খুলনা উপকূলে আঘাত হেনেছিল। ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরা, ২০১৯ সালের ২ মে ফণী, ২০২০ সালের ১৮ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস, ২০২২ সালের ৭ মে অশনি একই বছরে সিত্রাং এবং ২০২৩ সালের ১৪ মোখা আঘাত হেনেছিল। হিসাবে প্রতি বছর মে মাসে নিয়মিতভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঁচড়ে পড়ছে উপকূলে। এবার আসছে রিমাল। ফলে মে মাস এলেই খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করে। ঘরবাড়ি ও সবকিছু হারানোর আতঙ্কে থাকেন মানুষজন।
এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়রা উপজেলাটির সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালি এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় দুই কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় তিন কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি বাড়লে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ইতোমধ্যে রিমালের প্রভাবে কয়রার শাকবাড়িয়া ও কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১০ কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন উপকূলের তিন লাখ বাসিন্দা। উপকূলীয় এলাকা এবং নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে বলেছে উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানার, কয়রা উপকূলের কপোতাক্ষ নদী ও শাকবাড়িয়া নদী এলাকায় তিন লাখের বেশি মানুষজন বসবাস করে আসছেন। ঝড় এলেই তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হন তারা। ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হলেও সর্বনাশ ডেকে আনে জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়ে এখানকার মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। এমন পরিস্থিতিতে নিচু জায়গায় উঁচু বাঁধের ও নদীভাঙন প্রতিরোধের দাবি জানিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২২- ২০২৩ অর্থবছরের শেষের দিকে কয়রা উপজেলায় এক হাজার ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২ কিলোমিটার বেঁড়িবাধ নির্মাণ কাজ চলমান। ২০২৩ সালের শেষের দিকে জাইকার অর্থায়নে ১০০ কোটি ব্যয়ে দেড় কিলোমিটার বেঁড়িবাধ মেরামত করা হয়। এর আগে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে কয়রা উপজেলার ২১টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়া স্থানগুলো মেরামত করা হয়। এখনও অনেক স্থান ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের দাবি, উপকূলীয় ওই তিন জেলার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে। আরও কিছু এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। বাঁধের যেসব অংশ ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো পর্যবেক্ষণে রেখেছে পাউবো।
উপকূলীয় বেশ কিছু এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন পোল্ডারের বাঁধ পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক স্থানে সংস্কারকাজ শুরু করা হয়েছে। বাকি কাজও দ্রুত শুরু করা হবে। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
আতঙ্কের কথা জানিয়ে কয়রা উপকূলের বাসিন্দা মজিবর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মে মাস এক আতঙ্কের নাম। গত বছরের ঝড়ে আমার বাড়ির সব ভেসে গিয়েছিল। কোনও রকমে এখন ঠিক করে বাস করছি। আবার আসতেছে। ঝড় এলে পরিবার নিয়ে স্কুলে গিয়ে উঠি। ঝড় আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রতি বছরই আসে, বাঁধ ভাঙে, ঘরবাড়ি নিয়ে যায়। গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করি। এবারও ঘরবাড়ি হারানোর আতঙ্কে আছি।’
কয়রা সবুজ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বেড়িবাঁধের উচ্চতা বাড়াতে না পারলে উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। কয়রার বাঁধগুলোর উচ্চতা আরও অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো উচিত।’
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুস সালাম খান বলেন, ‘এতকাল যত দুর্যোগ এসেছে, অধিকাংশই মে মাসে। এজন্য মে মাস এলেই আতঙ্কে থাকেন উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড় না হলেও এ সময় নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে। প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সময়মতো মেরামতের উদ্যোগ নিলে কম খরচ ও কম সময়ের মধ্যে মানসম্মত কাজ করা সম্ভব। কিন্তু বর্ষার আগ মুহূর্তে জোয়ারের পানি বাড়লে পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয়। এতে একদিকে খরচ বাড়ে, অন্যদিকে তড়িঘড়িতে কাজ হয় নিম্নমানের। ফলে উপকূলে ঝুঁকি কমছে না, বরং বাড়ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইলার সেই ক্ষত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ফণী, ওই বছরই বুলবুল, ২০২০ সালে আম্পান, ২০২১ সালে ইয়াস, ২০২২ সালে অশনি এবং ২০২৩ সালে মোখা আঘাত হানে। এতে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বশেষ রিমালে আতঙ্কে আছেন স্থানীয় লোকজন।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপসহ বিভিন্ন উপজেলায় আঘাত হানতে পারে। এজন্য উপজেলাসমূহে ৬০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র ও তিনটি মুজিব কেল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় পাঁচ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’