Image default
বাংলাদেশ

এই ফল শিক্ষার মান ও প্রকৃত মূল্যায়নের কথা বলে কি?

দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর দ্বিতীয়বারের মতো এসএসসি পরীক্ষায় বসেছিল শিক্ষার্থীরা। করোনার ধাক্কা আমরা মোটামুটি কাটিয়ে ঊঠেছি; কিন্তু করোনার যে অভিঘাত শিক্ষায় পড়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। এজন্য যেমন টেকসই কর্মসূচি নিতে হবে, তেমনই এর বাস্তবায়নেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

মাধ্যমিকের এ পরীক্ষার্থীরা ২০২০ সালে নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরু করার মাত্র আড়াই মাসের মাথায় করোনার কারণে তাদের সরাসারি ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়।

২০২১ সালে দশম শ্রেণি শেষ করা পর্যন্ত সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ তারা খুব কমই পেয়েছে। অনলাইন আর অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক লেখাপড়াই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন।

এরপরও স্বাভাবিক সময় বা ২০১৯ ও ২০২০ সালের পরীক্ষার্থীদের চেয়ে এ ব্যাচটির পাশের হার বেশি। ২০১৯ সালে পাশের হার ছিল ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ আর ২০২০ সালে ছিল ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। শুধু পাশের হারে নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের তুলনায়ও এবার ভালো করেছে এ ব্যাচটি।

এ ব্যাচকে করোনার ব্যাচ বলেই অভিহিত করেছেন কেউ কেউ। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তারা জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালের পরীক্ষার্থীদের চেয়ে তাদের পাশের হার বেশি। তবে গত বছরের তুলনায় এবার হার কমেছে। এসএসসিসহ ১১টি বোর্ডে পাশের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ সাফল্য হিসাবে বিবেচিত জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী। গত বছর ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল।

২০২০ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন আর ২০১৯ সালে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় তিন বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা শিক্ষার্থীদের পাশের হার কম হলেও এর আগের চার বছরের মধ্যে এবার পাশের হার সর্বোচ্চ। আর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অতীতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি, তাদের সামনের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার পরই একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয় আর সেটি হচ্ছে-কত শতাংশ পরীক্ষার্থী পাশ করেছে আর কত শতাংশ পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে।

এ দুটি মানদণ্ড কি আসলেই শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মানের কথা বলে? এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সমান্তরাল আন্তর্জাতিক পরীক্ষা হচ্ছে ‘ও’ লেভেল, যেখানে কোনো ধরনের প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করা হয় না, যেখানে কোনো ধরনের প্রশ্ন শুধু মুখস্থ করে কিংবা দেখাদেখি করে টিক দিয়ে পাশের হার বা জিপিএ-৫কে ভারি করা হয় না।

একজন শিক্ষার্থী যখন ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় একটি বিষয়ে ‘এ’ প্লাস পায়, তখন কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়া ধরে নেওয়া হয় যে সে ওই বিষয়ে আসলেই ভালো। সে আন্তর্জাতিক যে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে। আমাদের এসএসসির এ-প্লাস কিন্তু সে কথা বলে না। এখানে এখনো প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে, প্রশ্নফাঁস করা নিয়ে অনেকেই ব্যস্ত থাকে। এখন প্রশ্ন কমন পড়ানো নিয়ে অনেকেই পাণ্ডিত্য জাহির করে।

এখন একটু দেখা যাক এবার পরীক্ষায় এত ভালো ফল করার কারণ কী কী। এগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস। এছাড়া আছে প্রশ্নপত্রে অধিকসংখ্যক বিকল্প থেকে পছন্দের সুযোগ, ৫০-এর মধ্যে দেওয়া পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর ১০০তে রূপান্তর, কঠিন বিষয়ে অবলীলায় ৯০ শতাংশের উপরে প্রাপ্তি এবং সাবজেক্ট ম্যাপিং।

গত বছরও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলা, ইংরেজি, গণিতের মতো বিষয় বাদ দিয়ে কেবল বিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিজ আর মানবিকের ঐচ্ছিক তিন বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু এবার সংক্ষিপ্ত ঐচ্ছিক বিষয়ের সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, চতুর্থ বিষয়সহ নয়টি পত্রের পরীক্ষা নেওয়া হয়। গত বছর বাকি নয় বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং বা জেএসসি-জেডিসিতে প্রাপ্ত নম্বরপ্রাপ্তির প্রবণতা অনুযায়ী নম্বর দেওয়া হয়। কিন্তু এবার এ সুযোগ দেওয়া হয় মাত্র তিন বিষয়ে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিকতা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বিষয়টি। এ ব্যাচকে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিকল্প সংখ্যাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বাভাবিক সময়ে সৃজনশীল অংশে ১১টি প্রশ্নের মধ্য থেকে সাতটির উত্তর করতে হতো। এবার ১১টি প্রশ্নই ছিল, কিন্তু উত্তর দিতে হয়েছে তিনটি প্রশ্নের। আবার এমসিকিউ অংশে ৩০টির মধ্যে সবকটির উত্তর দিতে হতো। কিন্তু এবার ১৫টির উত্তর দিতে হয়েছে। এছাড়া পরীক্ষার্থীরা ৫০ নম্বরে পরীক্ষা দিলেও সেটিকে ১০০ ধরে প্রাপ্ত নম্বর দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ই পাশ ও জিপিএ-এর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে। এগুলোর কোনোটিই মানসম্মত মূল্যায়ন নয়।

আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে ইংরেজি ও গণিতের মতো বিষয় কঠিন হিসাবে বিবেচিত। এসব বিষয়েও এবার শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। ঢাকা বোর্ডে বিষয়ভিত্তিক পাশের হারে দেখা যায় ইংরেজিতে ৯৬ দশমিক ৬৫ এবং সাধারণ গণিতে ৯৪.৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চতর গণিতে ৯৮.৯৮ শতাংশ, মানবিকে অর্থনীতিতে ৯৭.৪৫ শতাংশ আর বিজনেস স্টাডিজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিসাববিজ্ঞানে ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ পাশ করেছে। এবার যে তিন বিষয়কে সাবজেক্ট ম্যাপিং ও আওতায় নেওয়া হয়, সেগুলো মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কঠিন বিষয়গুলোর একটি। যেহেতু এটির জন্য পরীক্ষায় বসতে হয়, তাই পাশের হার ও জিপিএ-৫-এ এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এবার সারা দেশের ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো পরীক্ষার্থীই পাশ করতে পারেনি, যার মধ্যে ৪১টিই মাদ্রাসা।

আর ২ হাজার ৯৭৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাশের হার শতভাগ। ইংরেজি ও গণিত মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কারণ এ দুটি বিষয়ে একমাত্র স্বনামধন্য কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলোয় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই। শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই এ দুটি বিষয়ের দুর্বলতা নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার স্তর পার করে। অথচ পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হারে কোনো এক জাদুর পরশে দেখা যায় এ দুটি বিষয়ে পাশের হার আকাশছোঁয়া।

এর মানে কী? আমাদের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল, তারা দেশের বাইরে গিয়ে কিংবা দেশেও বিভিন্নভাবে তাদের মেধার ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে, অথচ তাদের পদ্ধতিগত দুর্বল মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আর তাই তাদের ফল নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টিতে নজর দেওয়া একান্তই প্রয়োজন।

Related posts

ঝালকাঠি জেলা বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর, সম্মেলন পণ্ড

News Desk

বৃষ্টির দেখা নেই, আমন রোপণে দুশ্চিন্তায় কৃষক

News Desk

ডিসেম্বরের মধ্যেই কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করার নির্দেশ

News Desk

Leave a Comment