Image default
বাংলাদেশ

একসঙ্গে ৪ মৃত্যু দেখে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের দায়িত্ব নিলেন ভ্যানচালক

নীলফামারীর সদর উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের দারোয়ানী শাহপাড়ার অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে একসঙ্গে চার জনের মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছেন। বিভিন্ন সময় ট্রেন দুর্ঘটনায় আরও হতাহতের ঘটনা দেখে সেই রেলক্রসিং দিয়ে নির্বিঘ্নে মানুষের পারাপারের দায়িত্ব নিয়েছেন ভ্যানচালক আলমগীর হোসেন। ক্রসিংয়ের দুই পাশে বাঁশ গেঁথে তৈরি করেছেন ব্যারিকেড। রাত কিংবা দিনে ট্রেন আসার সময় হলেই দৌড়ে সেই ক্রসিংয়ে গিয়ে হাজির হন। বাঁশ দিয়ে আটকে দেন দুই পাশ। সিগন্যাল দিয়ে থামিয়ে দেন মানুষের চলাচল। তার এমন দায়িত্বপূর্ণ কাজে সন্তুষ্ট পরিবার ও এলাকার মানুষ।

আলমগীর হোসেন (৪৮) ওই উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের দারোয়ানী শাহপাড়া গ্রামের মমতাজ উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। নিজের জমি-জমা নেই। পড়াশোনাও করেননি তেমন একটা। এক খণ্ড সরকারি জমির এক কোণে স্ত্রীসহ দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন। উপার্জনের সম্বল একটি ভ্যান আর রেল লাইনের ধারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। সেই আয়ে চলে তাদের পাঁচ জনের সংসার। দুই ছেলে আমিনুর রহমান ও দিনার আলম এবার এসএসসি পাস করে একটি মাদ্রাসায় আলিমে ভর্তি হয়েছেন। একমাত্র মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম (৪৫) ওই চায়ের দোকানটি করেন।

রেলক্রসিংটি দারোয়ানী রেল স্টেশনের শাহপাড়া গ্রামে। গত ২৬ জানুয়ারি সকালে সেখানে ট্রেনের ধাক্কায় ইজিবাইকের চার যাত্রী মারা যান। আহত হন চার জন। চোখের সামনে ওই দুর্ঘটনা দেখে ভ্যানচালক আলমগীর স্বেচ্ছায় সেখানে মানুষের পারাপারের দায়িত্ব নেন। ঘটনার পরদিন ট্রেন আসার আগে দুই পাশে বাঁশ বেঁধে রেলক্রসিং বন্ধ করে রাখেন।

তিনি বলেন, ‘চোখের সামনোত ইজিবাইকে ট্রেনের ধাক্কায় উত্তরা ইপিজেডের চার নারী শ্রমিকের একে লগে মৃত্যু দেখেছি। আরও চার জনের ট্যাং পাও ভাঙ্গিয়া পঙ্গু হয়া পড়ি আছে। সেটা চোখে দেখে নিজের বাঁশঝাড় থাকি দুইটা বাঁশ কাটি আনি পরদিন ভোর থাকি গেটোত পাহারা দেওয়া শুরু করনু।’ অভাবের সংসার হলেও ওই কাজে আপত্তি নেই তার। আপত্তি নেই পরিবারেরও।

এক প্রশ্নের জবাবে মহান কাজ করা এ ব্যক্তি বলেন, ‘সবার উচিৎ সরকারকে সহযোগিতা করা। মানুষে কয় দেশে অসংখ্য ল্যাংটা (অরক্ষিত) রেলক্রসিং আছে। এসব রেলক্রসিং পারাপারে এলাকার মানুষ দায়িত্ব পালন করলে রক্ষা পাবে অনেক জীবন।’

স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম (৪৫) বলেন, ‘মোর স্বামী রেল গেটের পাহারাত যেয়া ভ্যানের ভাড়া নিয়া শহরোত যাবার পারে না। এতে কিছুটা কামাই (আয়) কমেছে। এ জন্য ছেলেদেরকে নিয়ে বাড়ির কাজের পাশাপাশি লাইনের ধারোত চায়ের দোকান করি।’

বড় ছেলে আমিনুর রহমান বলেন, ‘বাবাতো ভালোর জন্য কাজ করছেন। এ জন্য আমাদের কষ্ট হলেও মেনে নিচ্ছি। বরং একাজে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।’

ভোরে ট্রেন আসার আগেই রেল গেটে হাজির আলমগীর জানান, ভোর ৫টার দিকে খুলনা থেকে চিলাহাটিগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন ওই রেলক্রসিং পেরিয়ে চলে যায় চিলাহাটির উদ্দেশে। তখন রেলক্রসিং পারে উত্তরা ইপিজেডের শ্রমিকদের প্রচুর ভিড় জমে। এরপর সকাল ৭টার দিকে নীলফামারী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস, সকাল ৮টার দিকে খুলনার উদ্দেশে খুলনা মেইল, সাড়ে ৮টার দিকে একই পথে রূপসা এক্সপ্রেস, বেলা ১২টার দিকে রাজশাহী থেকে চিলাহাটির উদ্দেশে তিতুমীর এক্সপ্রেস চলে। বেলা ৩টার দিকে রাজশাহীর উদ্দেশে ফিরতি তিতুমীর, বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা থেকে চিলাহাটির উদ্দেশে নীলসাগর এক্সপ্রেস, রাত ৯টার দিকে রাজশাহী থেকে চিলাহাটির উদ্দেশে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস এবং এর আগে পিছে ঢাকার উদ্দেশে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলাচল করে ওই রেলগেট দিয়ে।

আলমগীর বলেন, ‘হাতোত ঘড়ি নাই, তা কী হইছে। লাইনের ধারত বাড়ি। যেইঠে থাকো না কেন ট্রেনের হুইসেল পইলে হাজির হও রেলগেটোত। ওইটা শুনিয়া মুই বাঁশ দিয়া গেট বন্ধ করো। ট্রেন যাওয়ার পর খুলি দেও। এলাকার মানুষ ভালোই কয়।’

সোনারায় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম শাহ বলেন, ‘ওই গেটটি মানুষ মরার ফাঁদ। নিঃসন্দেহে আলমগীরের এটি একটি মানবিক কাজ। তার মতো একজন ভ্যানচালক নিজের ইচ্ছায় কাজটি করায় এটি সমাজের উদাহরণ। এ জন্য পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।’

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। তার ওই দায়িত্ব পালনে গেটের দুই পাশের সড়কে আরসিসি পিলারের জন্য আবেদন করেছিলেন। সেটি উপজেলা পরিষদ থেকে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও তিনি নিম্ন আয়ের একজন মানুষ, পরিবার রয়েছে। এ জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচি থেকে নিয়মিত সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে।’

নীলফামারী পুরাতন স্টেশনের মাস্টার ওবায়দুল রহমান রতন বলেন, ‘ওই রেলক্রসিং অতিক্রম করে চিলাহাটি থেকে রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা পর্যন্ত প্রতিদিন ১২টি ট্রেন চলাচল করে। দুর্ঘটনা রোধে দারোয়ানী স্টেশনের কাছে অরক্ষিত একটি রেলগেটে আলমগীর নামের এক ব্যক্তির দায়িত্ব পালনের কথা শুনেছি। তিনি নিজ দায়িত্বে সে কাজটি করছেন।’

উল্লেখ্য, নীলফামারী জেলা শহর থেকে চিলাহাটি সীমান্ত পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এ পথে মোট ক্রসিং আছে ৩৮টি। এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে বৈধ ৩৬টি। এর মধ্যে গেটম্যান আছে ১২টিতে। বাকি ২৪টি অরক্ষিত। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সদরের কুন্দপুকুর ইউনিয়নের বৌবাজার রেল ক্রসিংয়ে তিন শিশু ও এক যুবকসহ চার জন এবং চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি দারোয়ানী শাহপাড়া রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় মারা যান চার জন।

Source link

Related posts

একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটিতে মৃত ব্যক্তির নাম

News Desk

হঠাৎ কেন অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম?

News Desk

কুয়াকাটার পথে নিহত ৬ জনের জানাজাও হলো একসঙ্গে

News Desk

Leave a Comment