যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার ইসমাইল হোসেন (৪৯) একসময় কৃষিকাজ করতেন। ধান ও পাট উৎপাদনই ছিল মূল পেশা। এর ওপর নির্ভরশীল ছিল তার পরিবার। এতে লাভ দূরের কথা, মাঝেমধ্যে উৎপাদন খরচ উঠাতে হিমশিম খেতে হতো। তাই এসব ফসলের চাষ ছেড়ে দেন। শুরু করেন ফুল চাষ। দিনে দিনে বেড়ে যায় লাভ। বাড়ান বাগানের পরিসর। গত দুই যুগ ধরে ফুল চাষ করে এখন স্বাবলম্বী। হয়ে উঠেছেন চাষিদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বছরে এক জাতের ফুল বিক্রি করে লাভ করছেন ১৮ লাখ টাকা।
স্থানীয় ফুল চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইসমাইল হোসেন নতুন নতুন ফুল নিয়ে মাতোয়ারা এক চাষি। গত দুই যুগ ধরে ফুলের রাজ্যে বসবাস।
ইসমাইল হোসেন জানালেন, সবশেষ চন্দ্রমল্লিকা চাষ করেছেন। গত সাত বছর ধরে নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকা বিক্রি করছেন। এতে খরচ বাদ দিয়ে মাসে প্রায় ১৮ লাখ টাকা লাভ হয়।
ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার পানিসারা ইউনিয়নের পানিসারা গ্রামের রহমত উল্লাহ ছিলেন কৃষক। ধান ও পাট উৎপাদনই ছিল তার পেশা। বাবা রহমত উল্লাহর হাত ধরে কৃষিকাজে জড়িয়ে যান ইসমাইল। কৃষিতে তেমন লাভ না হওয়ায় ২০০১ সালে বাবার হাত ধরে ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ হন। গদখালীকে যিনি ফুলের রাজ্য হিসেবে গোটা দেশে পরিচিতি এনে দিয়েছেন, সেই শের আলী ইসমাইলদের এক বিঘা জমি লিজ নিয়ে প্রথম শুরু করেছিলেন ফুল চাষ। তাকে দেখে ২০০১ সালে ইসমাইল সেই এক বিঘা জমিতেই গোলাপ আর ডালিয়া ফুল চাষ করেন। এর মধ্যে ১০ কাঠায় গোলাপ আর ১০ কাঠায় ডালিয়া।
২০০৮ সালে জারবেরা চাষের চিন্তাভাবনা করেন। এরপর পিকেএসএফের আর্থিক সহায়তায় শুরু করেন ডাচ গোলাপ, জারবেরা ও কার্নিশন ফুল চাষ। সেখানেও সাফল্য পান। জারবেরা চাষে বেশ লাভ হতে থাকলো। কিন্তু ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ফুলের বাগান তছনছ হয়ে যায়। প্রায় ৭৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। হয়ে যান নিঃস্ব। এরপর নতুন উদ্যমে চন্দ্রমল্লিকা চাষ শুরু করেন। ২০২২ সালে গদখালীতে প্রথম টিউলিপ ফুল চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। কিন্তু এতে বেশি একটা লাভ করতে পারেননি।
চন্দ্রমল্লিকা চাষ শুরু
২০১৭ সালে জারবেরার জন্য তৈরি শেডে চন্দ্রমল্লিকা চাষের সিদ্ধান্ত নেন ইসমাইল। সে সময় ভারত থেকে প্রচুর চন্দ্রমল্লিকার চারা আসছিল দেশে। তার ভাবনায় ছিল, যেহেতু এখন ভারত থেকে জারবেরা আসছে না, তাহলে চন্দ্রমল্লিকার চারাও যাতে ভবিষ্যতে না আসে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সে কারণে তখন হুগলি, নাগপুর, বাগনাল ও ঘোড়াঘাটা এলাকায় যান। সেখানকার ২২টি নার্সারি থেকে যত জাতের পাওয়া গেছে সব ধরনের চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে আসেন। এরপর সেগুলো দেশের বিভন্ন জেলা শহরে পাঠানো শুরু করেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ছয় বিঘা জমিতে করা শেড নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রায় ৭৪ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
হাল ছাড়িনি, ভেঙে পড়িনি
এতো পরিমাণ ক্ষতির পরও ভেঙে পড়েননি জানিয়ে ইসমাইল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই সময় আমার দুই ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করি, এখন কী করা যায়। তাদের বলি, এখন ২০ হাজার টাকা হলে নতুন করে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে পারি। তখন আমার ক্ষেতে কিছু ডাচ গোলাপ ও কার্নিশানের চারা ছিল। সেগুলো সব বিক্রি করে দিই। এরপর পুরোপুরি শুরু হয় চন্দ্রমল্লিকার চাষাবাদ। তখন আমার কাছে প্রায় ৩০০ ভ্যারাইটির চন্দ্রমল্লিকা ছিল। লক্ষ্য করলাম, এসব ভ্যারাইটিতে ফুল ধরলেই গাছ নুয়ে পড়ে। গাছের সঙ্গে আলাদা করে বাঁশ দিয়ে খুঁটি বানিয়ে দিতে হতো। খরচ বেশি, আবার ফুলের সংখ্যাও কম। পাশাপাশি পুনে থেকে আনা ড্রপ ভ্যারাইটির গাছে দুই থেকে আড়াইশ ফুল ধরে। কিন্তু গাছ হেলে পড়ে না। সিদ্ধান্ত নিই, এটি চাষ করবো। আমার চাচা বাবুরও নার্সারি রয়েছে। তাকে বলি, চাচা আপনি তো পুনে যাচ্ছেন- আমাকে সেখান থেকে কিছু চন্দ্রমল্লিকার ভ্যারাইটি এনে যদি দিতেন তাহলে আবার দাঁড়াতে পারতাম। তিনি ১০টি ভ্যারাইটি এনে দেন। আম্পানের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আমি পুরোদমে চন্দ্রমল্লিকার পুনে ভ্যারাইটিতে মনোনিবেশ করি। অবশ্য, এর মধ্যেও দুবার আমাকে প্রায় নিঃস্ব হতে হয়েছে। তবু হাল ছাড়িনি কিংবা ভেঙে পড়িনি।’
এই চাষি আরও বলেন, ‘নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ এই অবস্থানে আছি। চন্দ্রমল্লিকার চারা বিক্রি ভাগ্যবদলের অন্যতম অনুষঙ্গ আমার। বর্তমানে শিশির নার্সারির এই পুনে ভ্যারাইটির চন্দ্রমল্লিকা কোনও জেলা শহরের নার্সারিতে না থাকলে তাদের অপূর্ণতা থেকে যায়। এই চন্দ্রমল্লিকা নিয়েই এখন আমার সব কাজ। কারণ এর মাধ্যমে আমি ইসমাইল আজ সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছি এবং সফল হয়েছি।’
খরচ আড়াই, বিক্রি পাঁচ
ইসমাইল বলেন, ‘চন্দ্রমল্লিকার উৎপাদন খরচ আড়াই টাকা। বিক্রি পাঁচ টাকা। সেক্ষেত্রে লাভ বেশি। অন্যান্য ফুলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লাভ হয়। চন্দ্রমল্লিকার উৎপাদন যেহেতু নিজেই করি, সে কারণে লাভ একটু বেশিই পাই। বছর শেষে এই ফুল থেকে খরচ বাদে প্রায় ১৮ লাখ টাকা লাভ থাকে।’
ইচ্ছে টিস্যু কালচার ল্যাব তৈরির
ইসমাইল হোসেনের পাঁচটি শেডে অর্থাৎ পাঁচ বিঘা জমিতে রয়েছে চন্দ্রমল্লিকার বাগান। সবগুলোই মাদার প্ল্যাট। এখান থেকে চারা পাঠান ঢাকা, চট্টগ্রাম, আশুলিয়া, সাভার, বরিশাল, নীলফামারী, রাজশাহী, খুলনা আর যশোর তো আছেই। আরও নতুন নতুন ভ্যারাইটি তৈরি করে দেশের সব নার্সারিতে পাঠাতে চান ইসমাইল। সেজন্য আরও উন্নত ও কালার ভ্যারাইটির জন্য টিস্যু কালচার ল্যাব তৈরির ইচ্ছে আছে। ল্যাব তৈরির জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানালেন।
যা বললেন কৃষি কর্মকর্তা
ইসমাইলের চন্দ্রমল্লিকার বাগানের বিষয়ে জানেন এবং খোঁজ রাখেন ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইসমাইল চন্দ্রমল্লিকার ১০ আইটেম উৎপাদন করে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছেন। এগুলো প্লাস্টিক ফুলের বিকল্প হিসেবে কিছুটা হলেও চাহিদা মেটাতে পেরেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসমাইলের বাগানে ২০-২২ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এটি ইতিবাচক। কৃষি অফিস তাকে নিরাপদ জৈব বালাইনাশক ব্যবহার, শেড তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছে।’
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা কৃষি অধিদফতরকে জানিয়েছি, ফুলের বিকল্প ব্যবহারের নিমিত্তে কিছু প্রকল্প যাতে হাতে নেওয়া হয়। বিদেশে যেমন ফুল দিয়ে নানা প্রসাধন, সৌরভ ইত্যাদি তৈরি করা হয়, তেমন কিছু যাতে আমরা এখানেও করতে পারি। এসব প্রকল্পে যদি দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে তাহলে আমাদের ফুলের একদিনের ব্যবহার কমে বরং সেটি দীর্ঘমেয়াদি পণ্যে পরিণত হবে। এসব কাজে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। আর বহুজাতিক কোম্পানি যদি বিনিয়োগ করে অনেকের কর্মসংস্থান হবে।’