কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩ উপজেলায় ১২টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সবকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শয্যা সংকটও। ফলে সঠিক চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন এসব উপজেলার লাখ লাখ রোগী। অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসাসেবার জন্য অনুপযোগী। সেখানে জটিল রোগে আক্রান্তরা পাচ্ছেন না যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা। চিকিৎসকের পাশাপাশি অন্যান্য পদেও জনবল ঘাটতি রয়েছে এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, সাধারণ চিকিৎসা ছাড়া জটিল কোনও রোগের চিকিৎসা এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেওয়া হয় না। এরপরও অধিকাংশ সময়ে চিকিৎসক পাওয়া যায় না। দায়িত্বে অবহেলা করেন চিকিৎসকরা। বহির্বিভাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় রোগীদের। মিলছে না যথাযথ চিকিৎসাসেবা।
কয়েকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে রোগী দেখার কার্যক্রম শুরুর কথা সকাল সাড়ে ৮টায়। কিন্তু সকাল ৯টায় করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের দীর্ঘ লাইন। তখনও চিকিৎসকদের কক্ষগুলো ফাঁকা। কোনও কক্ষে ঝুলছে তালা। চিকিৎসক আসেননি বলে রোগীদের টিকিট দিচ্ছেন না তাদের সহকারীরা।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যে কক্ষে শিশুদের দেখা হয়, সেখানে বসে আছেন অফিস সহায়ক মো. নজরুল ইসলাম। তিনি জানালেন, শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় এখানে রোগী দেখেন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট শাহনাজ পারভীন। এখনও তিনি আসেননি, তাই কোনও রোগীকে টিকিট দেওয়া হচ্ছে না।
দুই বছরের শিশুসন্তান রাজিব হোসেনকে নিয়ে করিমগঞ্জের বালিখোলা গ্রাম থেকে সকালে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছেন সুরমা বেগম। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রয়েছেন চিকিৎসকের দরজার সামনে। তার শিশুটি চার-পাঁচ দিন ধরে জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত। সুরমা বলেন, ‘বাড়িতে অনেক কাজ ফেলে সকাল-সকাল এসেছি। যেন চিকিৎসক দেখিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারি। কিন্তু কোনও কাজ হলো না, সকাল ৯টা বাজে, এখনও চিকিৎসক আসেননি। কখন আসবে, তাও জানাননি সহকারীরা।’
একই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ ধরনের ভোগান্তি নিত্যদিনের। যে উদ্দেশ্যে গ্রামগঞ্জের মানুষের সেবায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স খোলা হয়েছে, তা পূরণ হচ্ছে না। চিকিৎসকরা ঠিক সময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসক না পেয়ে রোগীদের ফিরে যেতে হয়। প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীরা।
এ ব্যাপারে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক আবু শাহেদ রনি বলেন, ‘এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যার। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক অনেক কম। যারা রয়েছেন, তিন ধাপে ভাগ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বহির্বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা সকালে আগের ভর্তি রোগীদের দেখেন। এ কারণে বহির্বিভাগে বসতে দেরি হয়। এরপরও এখানে প্রতিদিন সাত থেকে আটশ’ রোগী দেখেন চিকিৎসকরা।’
শুধু করিমগঞ্জ নয়, চিকিৎসক সংকটে জেলার আরও ১১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগীরা। বেশিরভাগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। যারা রয়েছেন তাদের অধিকাংশই মেডিক্যাল অফিসার কিংবা অ্যাসিস্ট্যান্ট। ফলে জটিল কোনও রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারেন না তারা। রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় জেলা সদর হাসপাতালে। আবার মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অধিকাংশ পদ শূন্য থাকায় অনেক পরীক্ষা রোগীদের বাইরে থেকে করাতে হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা।
জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে সদর ছাড়া সবগুলোতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। ১২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ ২৯৬টি। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে ১১৭টি। প্রেষণে অন্য জায়গায় কর্মরত ৩৬ জন। সবমিলিয়ে ১৫৩ জন চিকিৎসক ছাড়াই চলছে ১২টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এর মধ্যে করিমগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩২ জন চিকিৎসকের বিপরীতে আছেন ১২ জন। তাদের মধ্যে নিয়মিত ছুটিতে থাকেন অন্তত তিন জন।
এছাড়া তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৮ জনের বিপরীতে ১০, ভৈরব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯ জনের বিপরীতে ১৯, কুলিয়ারচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৬ জনের বিপরীতে আট, নিকলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭ জনের বিপরীতে ৯, বাজিতপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১ জনের বিপরীতে ১৪, পাকুন্দিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১ জনের বিপরীতে ২১, কটিয়াদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১ জনের বিপরীতে ১৩, হোসেনপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৮ জনের বিপরীতে ১৬, ইটনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৯ জনের বিপরীতে ছয়, মিঠামইন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৬ জনের বিপরীতে আট ও অষ্টগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৮ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র সাত জন।
চিকিৎসকের পাশাপাশি অন্যান্য পদে জনবল ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক মোহাম্মদ আলমাছ হোসেন। তিনি বলেন, ‘শুধু চিকিৎসক নয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকটে ন্যূনতম চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।’
একই সংকটের কথা বলেছেন অষ্টগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আলম শামীম। তিনি বলেন, ‘আসলেই চিকিৎসক সংকটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে সংকটের মধ্যেও রোগীদের যথাসাধ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। বিদ্যুতের সমস্যা ও মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের সংকটের কারণে রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না।’
সার্বিক সংকটের কথা জানিয়ে কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসক সংকটের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। কোনও কোনও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত জানাচ্ছি। আশা করছি, নতুন করে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হলে, এই সংকট কিছুটা কেটে যাবে।’