বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাত ও জলোচ্ছ্বাসে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২৯ হাজার ৬৫০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছে চার হাজার ৭৮৯ হেক্টর জমির ৪৮ হাজার ৫৭২ মেট্রিক টন ফসল। এতে ক্ষতি হয়েছে ১৭৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকার।
পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ। একজনের মৃত্যু ও আহত হয়েছেন ১৭ জন। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম।
কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি
রিমালের আঘাতে কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিমালের তাণ্ডব ও অতিবৃষ্টিতে জেলার ২৯ হাজার ৬৫০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছে চার হাজার ৭৮৯ হেক্টর জমির ৪৮ হাজার ৫৭২ মেট্রিক টন ফসল। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ১৭৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এটি আমাদের করা তালিকায় উঠে এসেছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি হতে পারে।’
জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় কৃষকের আরও ব্যাপক পরিমাণ ক্ষতি হবে উল্লেখ করে উপপরিচালক বলেন, ‘লবণাক্ততার কারণে সময় মতো মৌসুমি ফসল ফলাতে পারবেন না চাষিরা। যার প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনে। লবণাক্ততার এই সমস্যা কাটতে দীর্ঘ সময় লাগবে।’
এদিকে, জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে মৎস্যচাষিদের স্বপ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গবাদিপশুর খামারিরাও। মারা গেছে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি। বিনষ্ট হয়েছে পশুখাদ্যও। যার প্রভাব পড়তে পারে আসন্ন ঈদুল আজহার কোরবানির বাজারে। বিশেষ করে এই ঝড় তছনছ করে দিয়েছে নতুন উদ্যোক্তাদের ভবিষ্যত।
মৎস্য খাতে ক্ষতি
মৎস্যচাষিদের ক্ষতির পরিমাণ জানিয়ে জেলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিমালের আঘাতের পর জলোচ্ছ্বাসে বরগুনায় দুই হাজার ১৩৫ হেক্টর জমির ৪৬ হাজার ৯১২ পুকুরের ১১ হাজার ৬০ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে গেছে। সেইসঙ্গে চাষিদের অনেক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে মৎস্যচাষিদের অন্তত ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ৫৫০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে নতুন উদ্যোক্তারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এই খাতে জড়িত সবাইকে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি আমরা।’
প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে জেলার ছয় উপজেলায় ১৯টি গরু, চারটি ছাগল এবং তিন হাজার ৯৩০টি মুরগি মারা গেছে। খামারিদের খামারের অবকাঠামো ও পশুখাদ্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই খাতে ৩৮ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঈদুল আজাহা সামনে রেখে যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খামারিরা, তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। আমরা মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা পাঠিয়েছি।’
ভেঙে গেছে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলা সদরের ডালভাঙ্গা, মাঝখালি, পালের বালিয়াতলী, বাওয়ালকর, আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া, পশুরবুনিয়া, পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা, কালমেঘা, কাকচিড়া, বাহেরচর, জিনতলা, তাফালবাড়িয়া কাঁঠালতলী, চরদুয়ানি পদ্মা, বেতাগী উপজেলার দক্ষিণ সরিষামুড়ি, দক্ষিণ কালিকাবাড়ি, চরখালীসহ বিভিন্ন এলাকার ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে এসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দ্রুত মেরামত করা হবে।’
গত রবিবার রাতে বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এই ঝড়ের আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিভিন্ন জেলার মানুষের। জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের দুর্যোগসংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রিমালের আঘাতে দেশের সাত জেলায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া উপকূল ও এর আশপাশের ১৯টি জেলায় প্রায় পৌনে দুই লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৩৩৮টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮টি। আর এই ঝড়ে দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৬ লাখ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে বরিশাল অঞ্চলের ছয়টি জেলা। এগুলো হলো বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা। এ ছাড়া খুলনা অঞ্চলের চার জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন জেলা নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার জেলার কৃষিখাত বেশি আক্রান্ত হয়েছে।