‌‘এখনও ঘুমালে মনে হয় জলদস্যুরা এই বুঝি গুলি করলো’
বাংলাদেশ

‌‘এখনও ঘুমালে মনে হয় জলদস্যুরা এই বুঝি গুলি করলো’

‘এখনও রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। ঘুমালেই মনে হয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা মাথার ওপর অস্ত্র তাক করে রেখেছে। যেকোনো মুহূর্তে গুলি করতে পারে, এই বুঝি গুলি করলো। বন্দিদশার দুর্বিষহ রাত আর বীভৎস সকাল এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। জানি না, কখন এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারবো।’

জাহাজ থেকে নামার পর মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকালে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে দুর্বিষহ দিনগুলোর স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরলেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খান।

একে-৪৭ আগ্নেয়াস্ত্রের নাম শুনেছি, কখনও দেখিনি উল্লেখ করে আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘জিম্মি হওয়ার পর দেখলাম একে-৪৭ আমার মাথার ওপর। আমার দিকেই তাক করে রাখা। তখন বুঝেছি, পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর। শুধু যে একে-৪৭ ছিল তা নয়, অনেক বড় বড় মেশিনগান নিয়ে এসেছিল তারা। মাঝেমধ্যে এগুলো দিয়ে ফায়ার করতো। তখন বিকট শব্দ হতো। যখন ফায়ার করতো তখন আমাদের কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ বসে আছে। এ অবস্থায় তাদের ঘুম ভেঙে আতঙ্কে কাঁপতে থাকতো। সবার মনে হতো, কখন বুঝি কার ওপর গুলি করে দিলো। আমরা আশপাশে চেয়ে দেখতাম, আমাদের কারও ওপর গুলি করলো কিনা।’

সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ফিরেছেন এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক। তারা এমভি জাহান মণি-৩ লাইটার জাহাজে করে এসেছেন। এর আগে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় এমভি আবদুল্লাহ থেকে নেমে জাহান মণিতে ওঠেন। তাদের নিয়ে জাহাজটি বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল জেটিতে ভিড়ে। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে নাবিকরা একে একে জাহাজ থেকে নেমে আসেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাহাজ মালিকপক্ষ কেএসআরএম তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। টার্মিনাল জেটি চত্বরে তাদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

জিম্মি হওয়ার পর এমন দিন জীবনে আসবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় ছিল উল্লেখ করে আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘৩৩ দিন জিম্মি ছিলাম। একেকটা দিন একেকভাবে কেটেছে। মনে হয়েছে, কয়েক বছর। প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে দস্যুরা খারাপ আচরণ করলেও পরের দিনগুলোতে আচরণ পরিবর্তন হয়েছে। তবে সবসময় আমাদের চোখে চোখে রাখতো। মাথার ওপর অস্ত্র তাক করা থাকতো। এমনকি ঘুমাতে গেলেও মাথার ওপর অস্ত্র ধরে রাখতো। তাদের কাছে এমন সব ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল, যা আমি জীবনে কমই দেখেছি।’

বীভৎস দিনগুলোর স্মৃতি আমি কিছুটা কাগজে লিখে রেখেছি জানিয়ে আতিক উল্লাহ বলেন, ‘একসময় তা বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। এখন এসব বলেও শেষ করা যাবে না।’

বিকালে জাহাজ থেকে নেমেই দুই শিশুসন্তানকে বুকে টেনে নেন আতিক। আদর-ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখেন অনেকক্ষণ। তাৎক্ষণিক বলেছিলেন, ‘এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম।’

নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে জাহাজের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অক্ষত অবস্থায় ফেরত এসেছি। অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, বলে প্রকাশ করা যাবে না। তবে সবাই জীবিত ফিরতে পারবো কিনা, তা নিয়ে সংশয় ছিল। জিম্মিদশার ৩৩ দিন আমরা অনেক স্ট্রং ছিলাম। এখন দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। এই জীবনের জন্য দেশবাসীর ভালোবাসা ছিল। কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টা ছিল। সবার সহযোগিতায় সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পেরেছি।’

বিকালে নাবিকদের নিয়ে জাহাজটি বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল জেটিতে ভিড়ে

তাদের মতো উচ্ছ্বাস ছিল জ্যোৎস্না বেগমেরও। ছেলে তানভীর আহমেদ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী। জিম্মি হওয়ার পর চিন্তায় অস্থির ছিলেন। ছেলেকে পাওয়ার পর জ্যোৎস্না বলেন, ‘ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে। জিম্মি হওয়ার পর ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ৩৩ দিন কীভাবে কেটেছে, তা প্রকাশ করা যাবে না।’

নাবিকদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর কেএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৩ নাবিককে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। নাবিকরা সুস্থভাবে দেশে ফিরেছেন। এটাই ছিল আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। জিম্মিদশা অবস্থায় নাবিকরা মনোবল হারাননি। বলা যায় তারা অনেক সাহসী ছিলেন।’

এর আগেও আমাদের জাহাজ এমভি জাহান মণি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল উল্লেখ করে শাহরিয়ার জাহান বলেন, ‘তখন ৯৯ দিন পর নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওই বারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার এক মাসের মধ্যে নাবিকদের দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করতে পেরেছি আমরা।’ 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাহাজ মালিকপক্ষ কেএসআরএম নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। এসআর শিপিং সূত্র জানিয়েছে, গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে যাত্রা করে জাহাজটি। ১৯ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে এটি ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। জলদস্যুদের হাতে জিম্মির খবরে নাবিকদের পরিবারে নেমে আসে দুশ্চিন্তা। উৎকণ্ঠায় ছিলেন স্বজনরা।

শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিয়ে ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত করা হয়। মুক্তির পর আমিরাতের উদ্দেশে রওনা দেয়। ২১ এপ্রিল আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। এতে থাকা ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা সেখানে খালাস করা হয়। পরে আমিরাতের মিনা সাকার বন্দর থেকে ৫৬ হাজার টন চুনাপাথর লোড করা হয়। এসব পাথর নিয়ে দেশের পথে রওনা দেয়। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপকূলে নোঙর করেছিল।

Source link

Related posts

পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতেই ভাঙনে দৌলতদিয়ায় ফেরি ঘাট

News Desk

শীতে বেড়েছে রস, যশোরে তৈরি হবে শত কোটি টাকার গুড়

News Desk

জামালপুরে পানিবন্দি ১০ হাজার মানুষ, ২৬টি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা

News Desk

Leave a Comment