গ্রাহকের প্রায় ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জয়পুরহাটের চাঁনপাড়ার ‘আস্থা ট্রেডিং লিমিটেড’ নামে একটি এনজিওর বিরুদ্ধে।
ওই এনজিওর ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে শত শত গ্রাহকের। টাকা ফেরত পেতে পাঁচ মাস ধরে সংস্থাটির অফিসে ঘুরলেও কাজ হচ্ছে না। মামলা করেও মিলছে না সুফল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাত বছর আগে কখনও আস্থা ট্রেডিং লিমিটেড, কখনও সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সংস্থা লি., আবার কখনও ‘আস্থা লি.’, কখনোবা ‘পল্লী মানবতার সেবা সংস্থা (পমাসেস)’— এমন সব নামসর্বস্ব এনজিও খুলে চড়া মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে থাকেন একই এলাকার আসাদুজ্জামান ওরফে মানিক। প্রথম দিকে ভালো মুনাফা দিয়ে আকৃষ্ট করতে থাকে সাধারণ গ্রাহকদের। আস্থা ট্রেডিং লিমিটেডের নামে হাতিয়ে নিয়েছে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার পূর্ব কৃষ্ণপুর আদর্শ গ্রামের মৃত আফছার আলীর স্ত্রী রেনুকা বেওয়া, একই এলাকার মৃত ইউসুফ আলীর ছেলে আজিজুল—শ্রমিকের কাজ করেন। তাদের আয় থেকে জমানো টাকা রেখেছিলেন চাঁনপাড়া বাজার এলাকায় আস্থা ট্রেডিং লিমিটেডে। উদ্দেশ্য ছিল জমানো টাকা দিয়ে ভাঙাচোরা টিনশেড ভেঙে তৈরি করবেন ইটের বাড়ি। তবে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তাদের টাকা নিয়ে পালিয়েছে এনজিওটি। আমানতদারীদের কাছে পাঠানো হয়েছে উকিল নোটিশ। এখন নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছেন তারা। তার মতো হাজার হাজার গ্রাহক একই পরিস্থিতির শিকার। লাভ তো দূরের কথা জমানো আসল টাকাই পাচ্ছেন না তারা।
পূর্ব কৃষ্ণপুর আদর্শ গ্রামের মৃত আফছার আলীর স্ত্রী রেনুকা বেওয়া বলেন, এ বছরের শুরুর দিকে তিনি স্থানীয় আলুর হিমাগারে আলু বাছাইয়ের শ্রমিকের কাজ করেন। তার পরিশ্রমের জমানো ষাট হাজার ও তার মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে এক লাখ টাকা জমা করেন। মা ও মেয়ের মিলিয়ে মোট এক লাখ ষাট হাজার টাকা জমা রাখেন পাঁচবিবি উপজেলার চাঁনপাড়াতে অবস্থিত আসাদুজ্জামান মানিকের আস্থা ট্রেডিং লিমিটেড এনজিওতে। প্রতি মাসে তাকে এক লাখে তিন হাজার টাকা লাভ দেওয়ার কথা বলে। পরে টাকা তুলতে গিয়ে দেখতে পান অফিস ফাঁকা। এখন লাভ তো দূরের কথা আসল টাকাই পাওয়া যাচ্ছে না।
একই এলাকার আজিজুল বলেন, আদর্শ গ্রামের ভাঙাচোরা টিনের বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। স্বপ্ন ছিল ভাঙাচোড়া বাড়ি ভেঙ্গে ইট দিয়ে বাড়ি করবেন। তাই গরু লালনপালন ও শ্রমিকের কাজ করে কিছু টাকা জমা করেছিলেন। আজিজুলের গরু বিক্রির ও তার দুই ছেলের মিলিয়ে সাড়ে আট লাখ টাকা জমা রাখেন আসাদুজ্জামান মানিকের আস্থা ট্রেডিং লিমিটেডে। সেই টাকা এখন ফেরত দিচ্ছে না সংস্থাটি।
জয়পুরহাট শহরের সবুজনগর এলাকার বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, তিনি একটি বেসরকারি সংস্থাতে কাজ করতেন। আর তার স্ত্রী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তাদের দুজনের জমানো সাড়ে ১৮ লাখ টাকা জমা রাখেন আসাদুজ্জামান মানিকের এনজিওতে। প্রথমে কিছুদিন এক লাখে তিন হাজার টাকা করে মুনাফার টাকা নিয়মিত পরিশোধ করছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় লাভের টাকা দেওয়া। টাকা চাইতে গেলে মারধর ও অপহরণের শিকার হতে হয়। এ অবস্থায় উপায়ন্ত না পেয়ে টাকা ফেরতের জন্য আদালতে মামলা করেছেন তিনি।
জয়পুরহাট কেন্দ্রীয় আখ চাষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি সুমন মিয়া বলেন, সমবায়ের নামে প্রতারণা করে গ্রাহকের আমানতের টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি চাই।
আস্থা ট্রেডিং লিমিটেডসহ কয়েকটি ভুঁইফোড় এনজিওর নির্বাহী পরিচালক আসাদুজ্জামান মানিক সাংবাদিকদের বলেন, গ্রাহকদের জমানো টাকা তার সহযোগীরা নিয়ে আত্মগোপন করেছে। কিছু সমস্যার কারণে এমন পরিস্থিতি। ব্যবসায়িক পার্টনাররা পালিয়ে যাওয়ায় সব কিছু এখন তার উপর পড়েছে। আর কিছু অনিয়মের কারণে সংস্থাটির সনদ বাতিল করেছে। তাই কয়েকটির (সংস্থা) কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করতে হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলা সমবায় কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেন, নানা অনিয়মের অভিযোগে নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে ওই সংস্থার। এরপরও অবৈধভাবে এনজিওর নামে প্রতারণা করায় সমবায় আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহীউদ্দীন জাহাঙ্গীর বলেন, গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলেই কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।