ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শুক্রবার (২০ অক্টোবর) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। পূজার শুরু মহাষষ্ঠীতে প্রতিমার আসনে প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে বিসর্জন—সবখানেই ঢাকের বাজনা চাই-ই চাই। দুর্গোৎসব ঘিরে এ বাদ্য যারা বাজান, সেই ঢাকিদের চাহিদা ও কদর দুর্গোৎসবে বেড়ে যায়। ঢাকিরা সাধারণত পূজা শুরুর কয়েকদিন আগ থেকে মণ্ডপগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন। ঢাকিদের ভাড়া করতে প্রায় ৫০০ বছর ধরে ব্যতিক্রমী হাট বসছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার পুরান বাজার এলাকায়। কটিয়াদী উপজেলা সদরের কাছেই পুরান বাজার। রীতি অনুযায়ী, উৎসবের আগের দিন অর্থাৎ পঞ্চমী ও ষষ্ঠীর দুই দিন হাট বসে। এর নাম ‘ঢাকের হাট’। এবারও জমে উঠেছে এই হাট। বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সকাল থেকে শুরু হওয়া হাট চলবে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ঢাকের হাটে কোনও পণ্য কেনাবেচা হয় না। শুধু দুর্গাপূজার জন্য অর্থমূল্যের বিনিময়ে মণ্ডপ পরিচালনাকারীদের সঙ্গে ঢাকিরা চুক্তিবদ্ধ হন। কোন দলের মূল্য কত হবে, তা নির্ধারণ হয় উপস্থিত মুনশিয়ানা পরীক্ষার মাধ্যমে। দলের দক্ষতা বোঝাতে ঢাকিরা তাই হাটেই বাজনা বাজিয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, বাজনার তালে নাচ আর নানা ঢঙে অঙ্গভিঙ্গ প্রদর্শনের মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ার চেষ্টা করা তাদের পেশারই অংশ। ওই দুই দিন পুরান বাজারে ভিন্ন রকম উৎসবের আবহ তৈরি হয়। বাজনার শব্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। দক্ষতা দেখার পর চলে দর-কষাকষি। সাধারণত দলভিত্তিক চুক্তি হয়ে থাকে। প্রকারভেদে ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকেন তারা।
ঢাকের হাট ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকিদের সরব উপস্থিতি। এবার বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে আসা ঢাকির সংখ্যা বেশি। হাটে শুধু ঢাকি দল নয়, বাঁশি, সানাই, করতাল, খঞ্জনি, মন্দিরা, কাঁশি, ঝনঝনিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বায়না করা হয়।
কয়েকজন ঢাকির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই হাটে এলে চুক্তি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তাই তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকের হাটে আসেন। প্রতি বছর দলগতভাবে পূজা আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তি হন। চুক্তিমূল্য ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। এ বছরও তেমনটাই আশা করছেন। পূজার দিনগুলোতে বিভিন্ন মণ্ডপে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজারে আসা সবাই চুক্তিবদ্ধ হবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
অসিত কুমার দাস (৪২) পাঁচ বছর ধরে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থেকে পাঁচ জনের দল নিয়ে ঢাকের হাটে আসেন। এবারও এসেছেন। তিনি বলেন, ‘এই হাটে প্রতি বছর ভালো বায়নায় চুক্তিবদ্ধ হই। আগে হাটটি সম্পর্কে আমাদের জানা ছিল না। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই হাটের খবর জানতে পেরে গত পাঁচ বছর ধরে আসছি। আশা করছি, আজ-কালের মধ্যে ভালো দামে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবো। এবার আমাদের পাঁচ জনের দল ৩০-৩৫ হাজার টাকার মধ্যে বায়না পেলেই যেকোনো মণ্ডপে অংশ নেবো।’
ঢাকি দল ভাড়া নিতে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা থেকে এসেছেন রাজমোহন কুমার রায়। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাটে ঘুরেছি। বিভিন্ন ঢাকি দলের সঙ্গে কথা হয়েছে। বাদ্যযন্ত্র ও বাদকদের বাজনা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি। প্রতি বছর এই হাটে ভালো ঢাকি দল পাই। তাই এবারও এসেছি। গাজীপুরের একটি ঢাকি দলের বাজনা পছন্দ হয়েছে, দাম-দর ঠিক থাকলে চুক্তি করবো।’
ঢাকের হাট আয়োজক কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কটিয়াদী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুরুজিত ঘোষ বলেন, ‘এ হাটে প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক ঢাকি দল বিভিন্ন জেলা থেকে আসেন। তাদের ঘিরে হাটের আয়োজন। আয়োজক হিসেবে ঢাকি দল এবং যারা বাদ্যযন্ত্র বায়না করবেন, তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে থাকি। এবারও তাদের থাকা-খাওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। হাটে আসা সব ঢাকি দল চুক্তিবদ্ধ হতে পারে না। তখন তাদের গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজ প্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। উপজেলাটির চারিপাড়া গ্রামে ছিল ওই রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকির সন্ধান করতে বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীর কটিয়াদীর যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তীকালে স্থানান্তরিত হয়ে পুরানবাজারে বসে আসছে এ হাট।