প্রতি বছরই বাজেটের আগে নিজেদের কিছু দাবি দাওয়া তুলে ধরেন চা শ্রমিকেরা। প্রতিবারই তারা বাজেটে নিজেদের উন্নয়নে আলাদা বরাদ্দের দাবি জানান। তবে প্রতিবারই বঞ্চিত থাকতে হয় তাদের। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে বাজেট ঘোষণা করলেন তাতে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। ফলে হতাশ শ্রমিকরা। রপ্তানিমুখী এই শিল্পের প্রসারে আলাদা দাবি জানিয়েছিলেন চা বাগান মালিকরাও। তাদের সে দাবিও পুরণ হয়নি।
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জীবনমানের সব সূচকে পিছিয়ে থাকা চা শ্রমিকদের উন্নয়নে এবারের বাজেটে ১৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানিয়েছিলেন তারা। এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা নিশ্চিত, ভাষা ও সংস্কৃতির সুরক্ষা ও প্রতিটি চা বাগানে আইসিটি সেন্টার স্থাপনের জন্য এই বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল। এছাড়াও চা শিল্পকে পুনরায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসার দাবিও জানিয়েছিলেন তারা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের সবশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী দেশে চা বাগানের সংখ্যা ২৪৬টি এবং চা শ্রমিকের সংখ্যা মোট ২ লাখ ১১ হাজার ৮৪২ জন।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিবন্ধন করা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। অন্যদিকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে বাগানের সংখ্যা ২৩১টি এবং নিয়মিত শ্রমিক ১ লাখ ৩ হাজার। তাদের দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশে চা শ্রমিক জনগোষ্টীর মানুষ রয়েছেন প্রায় ১০ লাখ। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘বাংলাদেশে চা শ্রমিকরা অবহেলিত একটি জনগোষ্ঠী। আমরা প্রতি বছর পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে আলাদা বরাদ্দের দাবি জানাই। কিন্তু সরকার আমাদের সেই দাবি কখনও রাখেনি।
তিনি বলেন, এ বছর আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করেছি। জাতীয় সংসদে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট উত্থাপিত হয়েছে। আশা ছিল এবারের বাজেটে অন্তত চা শ্রমিকদের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকবে। এবারও আমরা নিরাশ হয়েছি। নৃপেন পাল বলেন, ‘সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, বাজেটে আমরা নিরাশ হলেও চা শ্রমিকদের জন্য যেন বিশেষ নজর দেয়া হয়। অন্তত চা শ্রমিকদের শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেন সরকার বিশেষভাবে নজর দেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক যুবরাজ ঝড়া বলেন, ‘শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে সারাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখনও চা শ্রমিক শিশুরা শিক্ষা বঞ্চিত। নারীরা গর্ভকালীন সঠিক চিকিৎসা পান না। যে কারণে মা ও শিশু অপুষ্টিতে ভোগে।
‘চা শ্রমিকরা যেন এই অবহেলা থেকে মুক্তি পায়, এর জন্য জাতীয় বাজেটে চা শ্রমিকদের জন্য আলাদা বরাদ্দ চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আমরা বঞ্চিত হয়েছি। তবে এখনও আশাবাদী চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী। তিনি বলেন, ‘আশা করি অন্যান্য চা উৎপাদনকারী দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও তার প্রয়োজন অনুযায়ী চা শ্রমিকদের জন্য আলাদা একটা বরাদ্দ রাখবেন। প্রতি বছর বাজেটের আগে আমরা বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরলেও সরকার এতে কর্ণপাত করেনি। আমরা আর বঞ্চিত থাকতে চাই না।
চা শ্রমিক সংগঠনের যুবনেতা মোহন রবিদাস বলেন, প্রতি বছর বাজেটের আগে সংবাদ সম্মেলন করে আমরা নিজেদের দাবি জানাই। এ বছরও চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ, জীবন মানের উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট আমাদের হতাশ করেছে। চা শ্রমিক নেতাদের বিরোধ আর ব্যর্থতার কারণেও শ্রমিকরা বঞ্চিত থাকছে বলে মনে করেন নারী শ্রমিক নেত্রী গীতারানী কানু। তিনি বলেন, নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে ন্যায্য দাবি আদায় হচ্ছে না। সন্মিলিতভাবে আন্দোলনও সম্ভব হচ্ছে না। আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল অধিকার আদায় সম্ভব।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সভাপতি নুরুল মোহাইমিন মিল্টন বলেন, চা বাগানের শ্রমিকরা বর্তমান সরকারের ভোট ব্যাংক হলেও সরকার চা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে কিছুই করছে না। বাজেটে কখনও তাদের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ রাখা হয় না। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত চা শ্রমিকরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে আসছেন। তাদের নেই ভূমির অধিকার, যখন তখন চাকরী হারাতে হচ্ছে। অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গে রয়েছে বেতন বৈষম্য। এগুলো দূর করে বাজেটে চা শ্রমিকদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখারও দাবি জানান তিনি।
চা শিল্পের উন্নয়নে বাজেটে অলাদা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই খাতের উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট অঞ্চলের সভাপতি জি এম শিবলী। তিনি বলেন, বর্তমানে চা বাগানগুলোতে খরার কারণে চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি চা বাগানে সেচের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এতে চা বাগানের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দরকার। জি এম শিবলী আরও বলেন, চা বাগানের জন্য বাজেট বরাদ্দ খুবই জরুরি। করোনার সময় অন্যান্য দেশ চা উৎপাদন বন্ধ রাখলেও বাংলাদেশ তা অব্যাহত রাখে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন হয়। লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি প্রকাশিত ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী চা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম। প্রতি বছর জাতীয় জিডিপির ১ শতাংশ আসে চা শিল্প থেকে।