বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে জেগে ওঠা বেলাভূমির অপর নাম কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। পৃথিবীর একমাত্র এ স্থানে দাঁড়িয়েই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের সুযোগ রয়েছে। এর দিঘল বেলাভূমি মুখোরিত হয় হাজারও পর্যটকের পদচারণায়। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটভূমি। নব্বইয়ের দশকের ঝাউবন, নারিকেল বাগান, গেওরা, ম্যানগ্রোভসহ নাম না জানা শত বনের ছায়ায় আশ্রয় নিতেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা পরিশ্রান্ত মানুষগুলো। কিন্তু সাগরের ক্রমাগত প্রবল ঢেউয়ের আঘাত ও পরিবেশ বিপর্যয়ে এক কিলোমিটারের প্রশস্ত সৈকত এখন জিরো পয়েন্টে ঠেকেছে। কুয়াকাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে এখন শুধু নোনা জলের ঢেউ আর হোটেল-মোটেলে কৃত্রিম সজ্জার ঘনঘটা। এ কৃত্রিমতায় নির্ভর ও অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন পর্যটকরাও। করোনার প্রথম ধাপেই নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ সৈকত।
টানা লকডাউনের গ্যাঁরাকলে অবরুদ্ধ হয় এখানকার সবকিছু। বন্ধ হয়ে যায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্র। আগের মতো চোখে পড়ে না স্থানীয় হোটেল-মোটেলে পর্যটকদের বরণের দৃশ্য। কোথাও কোনো ব্যস্ততা নেই। ব্যস্ততম সৈকত এখন ভূতুড়ে পরিবেশ। হাজারও পর্যটকের পদচারণায় মুখোরিত দিঘল সৈকত এখন নিস্তব্ধ। রাতের আকাশে ফানুস উড়িয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে না কেউ। মনে হয় প্রকৃতির অভিশাপে রূপান্তরিত হওয়া এক সিক্ত ভূমি। মানবের প্রকৃতিবিদ্বেষী আচরণে বিপর্যস্ত এখানকার প্রাকৃতিক ও মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।
এতকিছুর পরও নতুন দিগন্তের দ্বার খুলতে শুরু করেছে নির্মল মুক্ত প্রকৃতি। মনে হয় যেন পৃথিবীর সবকিছু ধূলিসাৎ হয়ে নতুনের প্রত্যয়ে পথ চলতে শুরু করেছে এক অচেনা ভূখণ্ড। সব মানবের প্রবঞ্চনা ভুলে আশীর্বাদ হয়ে ফুটে উঠেছে দর্শনীয় স্থানগুলো। বিশ বছরেও এমন বিরল দৃশ্য চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি কারও। আজ সেই চিত্র পর্যটন এলাকার আনাচে-কানাচে। বন্য পশুপাখিগুলো নতুন স্বাদের সম্মোহনে হাঁটি হাঁটি পায়ে লোকালয়ে আসতে শুরু করেছে। সুদীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকত ফুটে উঠেছে সাদা ঝিনুকের পসরা নিয়ে। বিলুপ্তপ্রায় লাল কাঁকড়াগুলো চিত্রশিল্পীর তুলি নিয়ে ছোটাছুটি করছে সৈকতের বেলাভূমিতে। লাল কাঁকড়ার অঙ্কন চিত্রে পুরনো সৈকত ফুটে উঠছে কোনো চিত্রশিল্পের ওয়ালে রূপ নিয়ে।
বঙ্গোপসাগরের নোনাজলের বুক চিরে জেগে ওঠা চরবিজয় এখন অতিথি পাখির অভয়াশ্রম। অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুগ্ধ হয়ে উঠেছে জাহাজমারা ও চরতুফানিয়া সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা। মানুষের ভয়ে অভয়ারণ্যে লুকিয়ে থাকা বন্যপ্রাণিগুলো লোকালয়ে এসে ছোটাছুটি করছে। সংরক্ষিত টেংরাগিরি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলেও দেখা মিলেছে বন্য হরিণের ছোটাছুটি। এমন অবিস্মরণীয় ঘটনায় হতভম্বের পাশাপাশি আনন্দিত পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন সৈকতের নোনাজলের রঙ ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন হচ্ছে বলে জানান স্থানীয়রা। আবার কেউ কেউ বলছে, আকাশের রঙের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জলের রঙের পরিবর্তন।
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কেএম বাচ্ছু জানান, পর্যটক না থাকায় জলের রঙ আর্কষণীয় হয়ে উঠেছে। এখন যেভাবে জলের রঙ ফুটে উঠছে তা এর পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। শুধু জলের রঙ নয়, গোটা কুয়াকাটার চিত্র পাল্টে গেছে। পর্যটকের অভাব মেটাতে কুয়াকাটা নতুন সাজে সাজতে শুরু করেছে। তবে এই সজ্জা বজায় রাখতে উদ্যোগী হতে হবে।