করোনা ভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে গত পয়লা বৈশাখ থেকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। বলা হয়েছে বিশেষ পরিসেবায় যুক্ত ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবেন না। জরুরি প্রয়োজনে কেউ রাস্তায় বের হতে চাইলে পুলিশের কাছ থেকে নিতে হবে ‘মুভমেন্ট পাস’ নামে বিশেষ অনুমোদন। কিন্তু কে শোনে কার কথা, নির্দেশনা উপেক্ষা করেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে রাস্তায় বের হচ্ছেন অনেকে।
জানা গেছে, লকডাউন ঘোষণার পর আলোচনায় এখন ‘মুভমেন্ট পাস’। জরুরিভিত্তিতে বাইরে যাওয়ার জন্য পুলিশের চালু করা এই পাসের ওয়েবসাইটে প্রতি ঘণ্টায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নাগরিকদের হিট। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর লকডাউনের গত দুদিনেই অতিপ্রয়োজনীয় মুভমেন্ট পাসের অপব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। খোদ পুলিশই বলছে, মুভমেন্ট পাস নিয়ে চলছে নানা প্রতারণা। মুভমেন্ট পাস পাওয়ার সাইটটি নিয়ন্ত্রণ করতে কর্তৃপক্ষ যখন হিমশিম খাচ্ছে তখন বাজার থেকে শিং মাছ কিনতে, ওড়না ডেলিভারি দিতে, চিকিৎসকদের খেজুর উপহার দিতে, ছাদে উড়ানোর জন্য ঘুড়ি কিনতেও জরুরি মুভমেন্ট পাস ব্যবহার করেছেন অনেকে।
লকডাউনের গত দুদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা তল্লাশি ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের জেরার মুখে এসব অজুহাত দেওয়া অনেকেই বিষয়গুলো স্বীকার করেছেন। তবে মুভমেন্ট পাস ব্যবহার করে এমন প্রতারণা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে আছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে ঠুনকো অজুহাতে ঘর থেকে বের হয়ে ঘোরাফেরা ও অপ্রয়োজনে মুভমেন্ট পাস ব্যবহার করায় বেশ কয়েকজনকে করা হয়েছে জরিমানা।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক সিগন্যালে ও মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট দেখা গেছে। যারা চলাচল করছেন তাদের ওই চেকপোস্টে ঘিরে ধরছে পুলিশ। সেখানে মুভমেন্ট পাস আছে কিনা তা নিয়ে পথচারী-যাত্রীদের পরতে হচ্ছে জেরার মুখে। যাদের পাস নেই, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাসায় কিংবা যেদিক থেকে আসছেন সেদিকে। গতকাল নিউমার্কেট, আজিমপুর, চানখাঁরপুর, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, পরীবাগ, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, কলাবাগান, সায়েন্সল্যাবে এমন অসংখ্য চেকপোস্ট দেখা গেছে। সকাল থেকে চেপোস্টগুলোতে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মোটরসাইকেল ও গাড়িতে করেও টহল দিতে দেখা গেছে পুলিশ সদস্যদের।
এদিন দুপুরে ওড়না ডেলিভারি দিতে মোটরসাইকেলে করে নিউমার্কেট এলাকায় যাচ্ছিলেন একটি অনলাইন পেজের মালিক আওলাদ হোসেন। শাহবাগ মোড়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে থামায়। এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু তাকে জিজ্ঞাসা করেন রাস্তায় বের হওয়ার কারণ। এ সময় আওলাদ হোসেন বলেন, ওড়না ডেলিভারি দেওয়ার জন্য নিউমার্কেট এলাকায় যাচ্ছি। এটি একটি জরুরি কাজ। জরুরি ডেলিভারি, তাই বের হয়েছি। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ফের জিজ্ঞেস করেন, আপনার এ কাজটি কি জরুরি? আওলাদ উত্তর দিলেন, আমি তো জরুরি জানতাম। বিষয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে জরুরি না হওয়ায় এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয় তাকে।
একই ভ্রাম্যমাণ আদালত ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির একটি গাড়িকে থামার ইশারা দেন। গাড়ির স্টিকারে লেখা ‘জরুরি ওষুধ সরবরাহের কাজে নিয়োজিত’। ম্যাজিস্ট্রেট দেখলেন গাড়ির ভেতরে কয়েকটি কার্টন। কীসের কার্টন জানতে চাইলে চালক জাহাঙ্গীর জানান, খেজুরের বাক্স। ডাক্তারদের উপহার দিতে কোম্পানি থেকে পাঠানো হয়েছে। কাজটি জরুরি না হওয়ায় ওই চালককেও হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় গাড়ির চালক প্রথমে জরিমানা দিতে রাজি হননি। এক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, আপনি জরিমানা সংগ্রহ করে দেন, নয়তো তিনদিনের বিনাশ্রম কারাদ- দেওয়া হবে। পরে অবশ্য ওই চালক জরিমানা দিয়ে মুক্তি পান।
গলায় বাংলাদেশ কাস্টমসের আইডি কার্ড ঝুলিয়ে রিকশায় শাহবাগ থেকে হাতিরপুলের দিকে যাচ্ছিলেন মানু ম-ল। কাস্টমস অফিস কি খোলা? আপনি কোথায় যাচ্ছেন? মাস্ক খুলে ফোনে কথা বলছেন কেন? ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করতেই মানু ম-ল কথা না বাড়িয়ে বলেন, আমার ভুল হয়েছে, আমাকে জরিমানা করেন। পরে ওই কর্মকর্তাকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
রিকশায় করে মুখে গামছা লাগিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন ইউসুফ আলী। র্যাব সদস্যরা রিকশা থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই দেখা যায়, পকেটে মাস্ক থাকলেও মুখে গামছা পেঁচিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ওই রিকশার আরোহী বলেন, মাস্ক পরলে গরম লাগে। তাই গামছা পেঁচিয়ে যাচ্ছিলাম। এই বক্তব্য যৌক্তিক না হওয়ায় জরিমানা গুনতে হয় তাকেও।
গতকাল সকাল থেকে শাহবাগে পরিচালিত ওই অভিযানে মোট ১৫ জনকে ৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সবচেয়ে বেশি জরিমানা গুনেছেন সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করা চালকরা। সড়কে চলাচলকারী অধিকাংশ লোকজনই ম্যাজিস্ট্রেটকে ‘হাসপাতালে যাব’- এমন কারণ দেখান।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ১৮টি নির্দেশনা ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কঠোর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে অভিযান চালাচ্ছি। অনেকেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কম প্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছেন। তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। তবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য জরিমানা নয়, আমরা সংক্রমণ প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতেই অভিযান চালাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনসাধারণ আগের তুলনায় বেশি মাস্ক পরে বাইরে বের হচ্ছেন। তবে অনেকেই প্রয়োজনীয় কারণ ছাড়া রাস্তায় বের হয়েছেন। যারা অপ্রয়োজনে বের হয়েছেন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাসহ জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে। যুক্তিযুক্ত কারণ দেখাতে না পারায় বেশ কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে।’
এদিকে গত বুধবার দুপুরে মুভমেন্ট পাস নিয়ে মোটরসাইকেলে করে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে মালিবাগ বাজারে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। পথে রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের সামনের চেকপোস্টে পুলিশ তাকে থামালে তিনি মুভমেন্ট পাস দেখান। কোথায় আর কেন যাচ্ছেন জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, মালিবাগ বাজারে যাচ্ছেন শিং মাছ কিনতে। বিষয়টি হজম হয়নি পুলিশের। একে মুভমেন্ট পাসের অপব্যবহার বলে মনে হয় ট্রাফিক পুলিশের। পরে ওই ব্যক্তিকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করেন সার্জেন্ট শেখ জোবায়ের আহমেদ। তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘরের বাইরে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা তা বাস্তবায়ন করছি। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে শিং মাছ কিনতে উত্তরা থেকে মালিবাগ যাওয়ার জন্য মুভমেন্ট পাস গ্রহণ অযৌক্তিক ও অপব্যবহার। তাই ওই ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছে।
একইভাবে ওইদিন সকালে রাজধানীর বকশিবাজারে পুলিশের চেকপোস্টে শাকিল নামে এক যুবককে আটকানো হয়। পুলিশের জেরায় শাকিল জানান, আজিমপুর থেকে হেঁটে তিনি বকশিবাজার এসেছেন। পুলিশকে একটি মুভমেন্ট পাসও দেখান তিনি। মুদি মালামাল কেনার জন্য নেওয়া মুভমেন্ট পাস নিয়ে এদিকে কোথায় যাচ্ছেন প্রশ্ন করলে শাকিল বলেন, মুদি বাজার করা শেষ, এখন একটা ঘুড়ি কিনতে যাই। আমার পাসে আরও এক ঘণ্টা সময় রয়েছে। বিস্মিত পুলিশ সদস্যরা শাকিলের কাছে জানতে চান, জরুরি প্রয়োজন কোনটা তিনি বুঝতে পারছেন কিনা? এর পরও তিনি ঘুড়ি কিনতে যেতে গোঁ ধরলে পুলিশ তাকে জোর করে বাসায় ফেরত পাঠায়।