মানবমন, সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে যে মেধাসম্পদ সৃজিত হয়, এর আইনগত স্বীকৃতি ও সুরক্ষাই হলো কপিরাইট। মূলত কপিরাইট দ্বারা মেধাসম্পদের ওপর প্রণেতার নৈতিক ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে উক্ত মেধাসম্পদ বিভিন্ন পন্থার পুনরুৎপাদন, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ, লাইসেন্স প্রদান এবং জনসম্মুখে প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে প্রণেতা বা সৃজনশীল ব্যক্তি একচ্ছত্র অধিকার লাভ করেন।
ফেসবুক থেকে ব্লগে কোনো লেখা কপি করলেই সার্চ ইঞ্জিন তা ধরে ফেলে। বা নিজের চ্যানেলে অন্য কারোর ভিডিও হুবহু তুলে দিলে সেখানেও এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। একেবারে চ্যানেল যায় যায় অবস্থা। কিন্তু কেন এমনটা হয়? আপনি হয়তো না জেনেই করেছেন কিন্তু তাও কেন তারা এমন হুমকি দিচ্ছে? অনেকেই হয়তো বিষয়টা ধরতে পেরেছেন আবার অনেকেই হয়তো বা পারেননি। তবে সমস্যা নেই। আজকে আমরা সেই, কপিরাইট,কপিরাইট কি এই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করব। জানতে হলে বিশদের সাথেই পড়তে থাকুন।
কপিরাইট কি?
কপিরাইট শব্দটি মূলত একটি (Copyright)ইংরেজি অভিধানের শব্দ । কিন্তু ডিজিটাল এই পরিস্থিতিতে তা যেন এখন বাংলার পারিভাষিক শব্দে পরিণত হয়েছে। যাই হোক এই কপিরাইট কথাটির মূল অর্থ হচ্ছে, গ্রন্থস্বত্ব, বা বলা যেতে পারে লেখস্বত্ব। বিভিন্ন বইয়ের কভারে বা ওয়েবসাইটের একেবারে নিচে এরকম কোনো কথা কখনো না কখনো নিশ্চয় চোখে পড়েছে। কিন্তু এই লেখকস্বত্ব বা গ্রন্থস্বত্ব বলতে আসলে কি বুঝায়? লেখকস্বত্ব হচ্ছে একজন রাইটার বা লেখকের রচনা করা কোনো বই বা পুস্তক মুদ্রণ, পুনঃমুদ্রণ এবং প্রকাশ করার যে অধিকার। একটি উদাহরণ দিয়ে আমরা বিষয়টাকে পরিষ্কার করতে পারি, ধরা যাক, বিখ্যাত লেখক আরিফ আজাদের কোনো প্রকাশ হয়েছে।
এখন আপনি তার এক কপি কিনে আনলেন। এরপর ভাবলেন আপনি সেই গ্রন্থটি নিজে প্রকাশ করবেন। এবং আপনি তা করলেনও। এতে করে দেখা গেল আপনার এই কাজের সন্ধান পেয়ে একদিন পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে গেল এবং বলল আপনি কপিরাইট আইন ভঙ্গ করেছেন। কপিরাইট আইন সমন্ধে আমরা পরে জানব। কিন্তু এখানে একটি বিষয় দেখুন আপনার কিন্তু বইটি মুদ্রিত বা প্রকাশ করার কোনোরকমের অধিকার আসলেই নেই। আবার একই কাজ যদি আরিফ আজাদ স্যার করতে চাইতেন, তাহলে অবশ্যই তিনি তা করতে পারতেন। কেননা গ্রন্থস্বত্ব তার কাছেই। আর প্রকাশনীও একই অধিকার রাখে!
কপিরাইট কথাটি দ্বারা কোনো একটি বিষয়ের উপর কারোর একচ্ছত্র অধিকার বুঝানো হয়। অর্থাৎ কেউ একটি বই রচনা করলো তা শুধু তারই। আপনার অধিকার শুধু আপনি তা কিনে পড়তে পারবেন। আর বর্তমানে মানুষের সাহিত্যকর্ম, মেধা, বুদ্ধিবৃত্তি ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য যেমন কপিরাইট রয়েছে ঠিক তেমনি নিজের তৈরি মোবাইল অ্যাপ বা কম্পিউটার সফটওয়্যার এর উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতেও কপিরাইট রয়েছে। কপিরাইট কি, কপিরাইট কাকে বলে, সেই প্রশ্নের জবাবে আমরা এই বিষয়টুকু অনুধাবন করতে পারি।
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট-বড় শহরের অনেক মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে গেলেই প্রকাশ্যে একশো বা দুইশো টাকার বিনিময়ে মোবাইলের মেমোরি ভর্তি করে গান, ভিডিও, চলচ্চিত্র নেয়া যায়। কিন্তু যিনি নিচ্ছেন, তিনি জানেন না যে, এভাবে গান বা ভিডিও নিয়ে তিনি আসলে কপিরাইট আইন ভঙ্গ করছেন। আর যে বিক্রেতা টাকার বিনিময়ে এগুলো দিচ্ছেন, তিনিও জানেন না যে, কতটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ তিনি করছেন।
কপিরাইট কাকে বলে?
পৃথিবীর দেশে দেশে সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের কপি বা পুনরুৎপাদনের, অবৈধ ব্যবহার ইত্যাদি বন্ধনের জন্য যে আইনের বিধান রাখা হয় তাকে কপিরাইট (Copyright) আইন বা সংক্ষেপে কপিরাইট বলে।
কপিরাইট আইন কি?
কপিরাইট আইন বলতে মূলত এমন একটি নিয়ম বা আইনকে বুঝানো হয় যা দ্বারা কেউ যদি উপরোক্ত বিষয়াবলি লঙ্ঘন করে তবে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার পাওয়া যায়। অর্থাৎ কেউ আপনার লেখা নিবে এই সংশয় থেকে বের হতে পারেন শুধুমাত্র এই আইনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ কপিরাইট আইন ও রয়েছে উন্নত দেশুগুলোর মতোই। দেশে প্রথম যে বছর কপিরাইট আইন নিবন্ধিত হয় তা ছিল স্বাধীনতার ৩ বছর পর ১৯৭৪ সালে। কালক্রমে এই আইন পরিবর্তিত, সংশোধিত হয়েছে। কেননা ডিজিটাল মিডিয়া যেমনঃ সিডি, সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপস ইত্যাদির কারণে আইনের ধরনকে পাল্টাতে হয়েছে।
যেমনঃ ২০০০ সালে প্রথম ১৯৭৪ সালের সেই আইনকে পরিবর্তিত করা হয়। আবার ২০০৫ সালেই সেই আইন আবার সংশোধনের দরকার পড়ে, ফলে সে বছর তা সংশোধিত হয়।
আর এই কপিরাইট আইন সমন্ধে বাংলাদেশের বৃহত্তম কোর্ট বা আদালত সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীর ভাষ্য কিছুটা এমন ছিল যে, উক্ত আইনটিতে সাহিত্যকর্ম, সংঙ্গীত,চলচ্চিত্র, শিল্পকর্ম এবং সাউন্ড রেকর্ডিং রয়েছে কপিরাইট আইনের আওতায়।
উক্ত লাইনটি থেকে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি যে, কোন কোন ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনটি মূলত কার্যকর। তবে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তা আবার একটু বেশিই কড়া। কিন্তু কেন?
কেননা উক্ত আইনজীবী তার পরবর্তী বক্তব্যে এই শাস্তির কথা তুলে আনেন, বিবিসি এর দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে সেটি ছিল কিছুটা এমন, চলচ্চিত্র ব্যতীত বাকি চার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চার বছরের জেল এবং ২লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। কিন্তু চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে জেলের সময়সীমা হলো ৫ বছর।
এই লাইনটি থেকে খুব সহজেই এই বিষয়টি অনুধাবন করা যায় যে, কপিরাইট আইন ভঙ্গ করলে একজনকে কি শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আর যিনি প্রকাশক তার ক্ষেত্রেও ভাষ্য কিছুটা এমন যে তার কাছে যদি উক্ত মেধাসম্পদের কোনোরকম রেজিস্ট্রেশন না থেকে থাকে তবে তাকেও নিস্তার দেয়া হবে না। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন থাকলেই কেবল প্রতিকার পাওয়া যাবে।
কপিরাইট কেন এতটা প্রয়োজন?
আপাতপক্ষে আপনার মনে হতেই পারে কেন এই কপিরাইট আইন, কি দরকার এত ঝামেলার? কিন্তু বিষয়টার কিন্তু একটা বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। আর তা বুঝতে হলে আমাদের সেই লেখক কিংবা প্রকাশকের অবস্থানে যেয়ে তারপর দেখতে হবে। এখন নিজেকে একজন প্রকাশক হিসাবে ভাবুন। ধরুন, আপনি একটি বই প্রকাশ করলেন একুশে বইমেলাতে। বইমেলাতে ভালোই বিক্রি হলো। এবং আপনার ইনকামও ভালো হলো।
কিন্তু বইমেলা শেষে হঠাত মে মাসে দেখলেন আপনার বইয়ের আবার তুমুল ঝড়। কিন্তু প্রকাশনার সাথে কথা বলে দেখলেন যে তারা তা প্রকাশ করেনি। কিন্তু করল কারা?
ওই যে শুরুতে বলেছিলাম আপনি যদি না বলে আরিফ আজাদের বই প্রকাশ করেন তাহলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াত। এই ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি কেউ আপনার মেধা, বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা লিখিত বই প্রকাশ করে বাণিজ্যিক ফায়দা হাসিল করে নিচ্ছে। জিনিসটা আপনার কতটা ভালো মনে হবে বা আপনি কোন চোখে দেখবেন?
বইটা লিখতে আপনার কম সময় মোটেও লাগেনি। কিন্তু অন্য কেউ যখন সেই বহুদিনের চিন্তার ফসল বিনা অনুমতিতে প্রকাশ করে বাণিজ্যিক ফায়দা হাসিল করবে বিষয়টা মোটেও ভালো লাগবে না, তাই না?
ঠিক তেমনিভাবে, একজন লেখক কিংবা ওয়েব ডিজাইনার বা একজন প্রকাশক সবারই টাকা প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে কেউ যদি বিনা অনুমতিতে তাদের সেই কৃতকাজকে নিয়ে নেয় এবং বাণিজ্যিক ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করে তবে তা তাদের হক মেরে খাওয়া হবে। লেখকও দ্বিতীয়বার কোনো বই প্রকাশ করতে নিরুৎসাহিত বোধ করবেন।
আর উপরোক্ত এসব বিষয় এড়াতে এবং একজন লেখকের মেধাবৃত্তিকে একটা চূড়ান্ত সুরক্ষা দিতেই মূলত এমনটা করা হয়। আশা করি প্রকাশক কিংবা লেখকের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে তার গুরুত্ব অনুভব করতে পারছেন।
কপিরাইট আইনের মেয়াদকাল কত?
কজন লেখক কিংবা প্রকাশক মারা গেলে তার কিন্তু আর কোনো টাকা পয়সার প্রয়োজন নেই। তাই সেই অবস্থায় যদি এমন বাণিজ্যিক ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করা হয় তবে তাতে কোনো রকমের প্রভাব পড়বে না। তবে মৃত্যুর পরই এমনটা সাধারণত হয় না। অর্থাৎ কপিরাইট আইন উঠে যায় না।
কপিরাইটেরও নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে। যেমন সাহিত্য কর্মের জন্য কবি বা লেখকের মৃত্যুর পর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকে।
তবে চলচ্চিত্র বা আলোকচিত্রের ক্ষেত্রে প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী বছর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কপিরাইটের মেয়াদ ৬০ বছর, তবে কখন থেকে সেই মেয়াদ শুরু হবে, বিভিন্ন ক্ষেত্র ভেদে সেটি আলাদা হতে পারে।
এতো কপিরাইট থাকলে মানুষ অন্যের ভিডিও ব্যবহার করে সেগুলো কি?
উপরোক্ত হেডিং এর মতোই পুরো আলোচনা শেষে আমাদের কাছে এক পরিস্থিতি উপস্থিত হতে পারে যে, মানুষ অন্যদের ভিডিও ব্যবহার করছে, অন্যদের ছবি ব্যবহার করছে সেগুলো মূলত কি?
এর উত্তর খুব সহজ ভাষায় দুটো শব্দেই দেয়া যায়। আর তা হলো এগুলো কপিরাইট ফ্রি ভিডিও এবং কপিরাইট ফ্রি ছবি। অর্থাৎ এগুলোর পিছনে কোনোরকম লেখকস্বত্ব, গ্রন্থস্বত্ব বা ছবিস্বত্ব নেই। বলা যেতে পারে মানবতার খাতির এবং নিজেদের জনপ্রিয়তা ফ্রিতে বাড়াতেই এগুলো প্রস্তুতকারকদের এমন সিদ্ধান্ত।
কপিরাইট আইন ২০০০
মূলত বাংলাদেশের পূর্বে একবার ধার্যকৃত কপিরাইট আইনের রিপ্লেসমেন্ট। অর্থাৎ পূর্ববর্তী সেই আইনকে হটিয়ে দিয়ে এই আইনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে এই আইনটিও সংশোধিত হয়। যা একটু পরেই জানা যাবে। যাই হোক পূর্ববর্তী অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের সেই আইনকে পরিবর্তিত করার মূল কারণটি মূলত ছিল পূর্বে কপিরাইটের আওতায় খুবই স্বল্প বিষয় ছিল কিন্তু ২০০০ সাল আসতে আসতে অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয় এর মধ্যে। কপিরাইট আইন ২০০০ এর আওতায় মোট ৪৮টি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়।
ফিল্ম বা চলচ্চিত্রের বিষয়টি আলোচনা করা হয়। সেখানে বলা হয় যে, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ এক্ষেত্রে মূল দাবিদার এবং তারাই কেবল কপিরাইট দিতে পারবে। সর্বোপরি ২০০০ সালের সেই কপিরাইট আইনকে মূলত বাংলাদেশের ডিজিটাল মিডিয়াগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সাজানো হয়। আর ২০০৫ সালেই এই আইন সংশোধিত হয়। যা আমাদের সবারই জানা।
কপিরাইট লঙ্ঘন হলে প্রতিকার
কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত অপরাধের মামলা ফৌজদারি বা দেওয়ানি আদালতে দায়ের করা যায়।