দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালে। কে জানতো, এত বছর পরেও টিকে আছে ওই বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের মরদেহের অংশ। এখনও সেই দেহাবশেষের অপেক্ষায় আছে পরিবার। বাংলাদেশে জাপানি সৈনিকদের দেহাবশেষ তুলে নিজ দেশে নিতে চলছে খননকাজ। পাওয়াও গেছে অনেকের মরদেহের অংশ। মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে (যুদ্ধসমাধি) গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জাপানে তাদের সৈনিকদের দেহাবশেষ নেওয়ার আন্দোলন চলে আসছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাপানিদের দেহাবশেষ নেওয়ার জন্য খননকাজ শুরু হয়। সর্বপ্রথম কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি (যুদ্ধসমাধি) থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ২৪ জন জাপানি সৈনিকের দেহাবশেষ উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। সেগুলো নেওয়া হবে জাপানে। ফরেনসিক পরীক্ষার পর আত্মীয়দের কাছে নেওয়া হবে সেসব জাপানির দেহাবশেষ। পরে সেগুলোকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে।
সূত্রে জানা গেছে, ১২ নভেম্বর জাপানের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল কুমিল্লার ওয়ার সিমেট্রিতে আসেন। ১৩ নভেম্বর তারা খনন শুরু করেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তি ছিল জার্মানি, জাপান, ইতালি, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া। সে সময় চেনার জন্য জাপানিদের মরদেহগুলো একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়। সেখানেই শুধু খননকাজ করছে তারা। এখন পর্যন্ত সেখানে ১৭-১৮টি কবর খনন করা হয়েছে। এর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন প্রায় ১০ জনের দেহাবশেষের অংশ পাওয়া গেছে। যার মাঝে দুই জনের শরীরের পূর্ণাঙ্গ অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিশেষ করে, বুকের হাড় ছাড়া প্রায় সব অংশের হাড় মিলেছে।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে ওয়ার সিমেট্রির মূল ফটক থেকে সামনের দিকের সব সমাধি দেখা গেছে। ভেতরের অংশে চলছে খননকাজ। সেখানে অস্থায়ী কয়েকটি ফটক তৈরি করে দর্শনার্থীসহ সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। রয়েছে কড়া নিরাপত্তা।
সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সেখানে আসেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক, জাপান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিকভারি অ্যান্ড রিপেটরিয়েশন অব ওয়ার ক্যাজুয়ালিটিসের পরিচালক টাটসুয়াকি ইনিউ, প্রধান আর্কিওলজিস্ট মি. মাইকেল।
জাপান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিকভারি অ্যান্ড রিপেটরিয়েশন অব ওয়ার ক্যাজুয়ালিটিসের পরিচালক টাটসুয়াকি ইনিউ বলেন, ‘জাপানি নাগরিকরা দীর্ঘদিন তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেহাবশেষ পাওয়ার অপেক্ষা করছেন। আমরা বহুদিন চেষ্টার পর এখন সরকার আমাদের সহযোগিতা করছে। এ দেশের মানুষ আমাদের পূর্বপুরুষদের দেহাবশেষ নিতে সহযোগিতা করছেন। আমরা সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা পাচ্ছি। আমরা এখানে খননকাজের জন্য এক্সপার্ট এনেছি। তারা সেগুলো সংরক্ষণ করছেন। এরপর নেওয়া হবে জাপানে। সেখানে ফরেনসিক টেস্ট করা হবে। আত্মীয়রা অপেক্ষায় আছেন সেগুলোর জন্য।’
কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক বলেন, ‘সমাধিস্থলটি খুবই চিন্তাভাবনা করে এমনভাবে করা হযেছে যেন মরদেহের ক্ষতি না হয়। তাই হয়েছে। আমরা প্রতিটি সমাধি দুই ফুটের মতো খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে খুঁড়ছি। সেখানে অনেকের হাতের অংশ, অনেকের মাথার খুলি, পায়ের হাড়, পিঠের হাড় ও চোয়ালসহ বিভিন্ন অংশ পাচ্ছি। তবে যারা তরুণ ছিলেন সম্ভবত তাদের শরীরের অংশ পাচ্ছি। বয়স্কদের শরীরের অংশ মিশে গেছে মাটিতে। কারোই আমরা বুকের অংশ পাইনি। কারণ সেগুলো নরম হাড় ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দীর্ঘদিনের খননের অভিজ্ঞতা; কিন্তু ৮১ বছরের কবর থেকে কঙ্কাল উঠানোর অভিজ্ঞতা বিচিত্র ও ভিন্ন। এখানে প্রতিটি হাড়কে একেকটি নবজাতকের মতো সংরক্ষণ করতে হয়। কারণ সেগুলো একবারেই নরম হয়ে গেছে। এখানে জাপানের সৈনিকদের ২৪ সমাধির মধ্যে ২০টির নাম-পরিচয় আছে। বাকি চারটির পরিচয় শনাক্ত করা এখনও সম্ভব হয়নি। নিশ্চয়ই জাপান প্রতিনিধি দল দেহাবশেষ নিয়ে গেলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হবে। যদি তা কোনও কারণে ম্যাচ না করে তাহলে আবার ফিরিয়ে আনা হবে।’
উল্লেখ্য, এই ওয়ার সিমেট্রিতে সমাহিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত বিশ্বের ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন বীর সৈনিকের মধ্যে জাপানি ২৪ জন। ফরেনসিক দল এই ২৪ জন সৈনিকের দেহাবশেষ সরিয়ে নিয়ে যাবেন। ২৪ নভেম্বরের মধ্যে এই কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা আছে। এর আগে, ১৯৬২ সালে একজন সৈনিকের দেহাবশেষসহ সমাধির মাটি তার স্বজনরা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান।