বাংলাদেশের আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, বিশিষ্ট শিল্পপতি কাজী শাহেদ আহমেদ স্মরণে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (৯ অক্টোবর) বিকালে যশোর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এ স্মরণ সভার আয়োজন করে কাজী শাহেদ আহমেদ স্মরণসভা পরিষদ। কাজী শাহেদ আহমেদের সহপাঠী আমিরুল ইসলাম রন্টু এতে সভাপতিত্ব করেন।
সভায় স্মৃতি হাতড়ে ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেছেন, ‘কাজী শাহেদ ভাই একদিন বললেন, কার অফিসে প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানো হবে। আমি প্রথমেই রাজি হই। পরদিন সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আমার রুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙাই। এক ঘণ্টা পর দেখি কাজী শাহেদ সেখানে হাজির। আগে আমাকে বলেননি যে, আমার অফিসে আসবেন। আমি আশা করিনি, উনি আসবেন। উনি ভাবলেন, ছোট ভাইকে বললাম ছবি টাঙাতে, ওর কী অবস্থা তাই চোখে দেখতে এসেছিলেন। এই কাজটা উনি দায়িত্ব ভেবেই করেন। আর এভাবেই তিনি সব ভালো কাজের সামনে ও পেছনে থাকতেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছি। একদিন পর জানতে পারি। খবরটা জানাতে কাজী শাহেদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে ওনার পা ছুঁয়ে সালাম করি। উনি আদর করে একটি কথা বললেন, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। জীবনে একটা সুযোগ এসেছে তার কন্যার মাধ্যমে সেই কাজের সহযোগিতা করা। আমার বিশ্বাস, এই কাজটা যাদের মাধ্যমে সম্ভব, তিনি তাদেরই নিয়েছেন।’
‘কাজী শাহেদ ভাইয়ের সেই কথা এখনও আমার কানে বাজে। যত সময় কাজ করেছি, আমি এই কথাটি মনে রেখেছি’, যোগ করেন তিনি।
২১ আগস্ট ভয়াবহ বোমা হামলার কথা স্মরণ করে ডা. মোদাচ্ছের বলেন, ‘অনেকেই জানেন না, ঘটনার পরপরই কাজী শাহেদ ভাই নেত্রীর সাথে দেখা করেছিলেন; তার সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে খোঁজ নেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাজী শাহেদ আহমেদ বাংলাদেশের প্রায় সব নামকরা শিল্পী-সাহিত্যিকদের খোঁজ রাখতেন। অনেক সময় আমাকে কর্মী হিসেবেও তাদের খেয়াল রাখার নির্দেশনা দিতেন। অনেক ভালো কাজ তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই করতেন। একমাত্র আলোয় পারে অন্ধকার দূরীভূত করতে। এই বিশ্ব থেকে যদি আমরা অন্ধকার সরাতে চাই, আমরা যদি যশোর থেকে শুরু করে গোটা বাংলাদেশ হয়ে বিশ্বকে আলোকিত করতে চাই, তাহলে আমাদের কাজী শাহেদ আহমেদের আলোকে ধারণ করার প্রচেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কেননা তিনি নিজেই ছিলেন আলো, আমরা কিছু মানুষ তার আলোয় আলোকিত হয়েছি মাত্র।’
সভায় বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পরের কঠিন সময়ে যে কয়জন মানুষ আবাহনী ক্লাবকে মেনে নিয়েছিলেন, পাশে শক্তভাবে দাঁড়ান, কাজী শাহেদ ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৭ সালে আমরা যখন মাঠে প্র্যাকটিস করছি, সেইসময় একজন ভদ্রলোক মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন। আমরা যেমন মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা হলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখি, তেমনই। তারপর তিনি আমাদের কাছে এসে আমাদের খোঁজ-খবর নিলেন, ক্লাবের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এরপর আস্তে আস্তে তিনি আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি প্রথম আমাদের ক্লাবের চেয়ারম্যান এবং তারপর থেকে তিনি আজীবন ডিরেক্টর ইনচার্জ ছিলেন।’
স্মৃতি হাতড়ে টুটুল বলেন, ‘১৯৭৭ সালে যদি কাজী শাহেদ ভাই ক্লাবের দায়িত্ব না নিতেন, আমার সন্দেহ হয়- আবাহনী ক্লাব আজ অবধি টিকতো কি না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, সোজা কথা বলতেন।’
১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘সেই সময় আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম, আতঙ্ক কাজ করে। কখন গ্রেফতার হই না কি খেলার মাঠে মারধরের শিকার হই। ১৯৭৭ সালে আমাদের একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার খুব প্রয়োজন ছিল। কেননা পাড়ার অনেক ছেলে ছিল- যারা আমাদের প্রতিদিন হুমকি-ধমকি দিতো। ভয়ে থাকতাম খুব। ওনার পরিচয় দিয়ে আমরা অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি।’
একদিনের ঘটনা উল্লেখ করে টুটুল বলেন, ‘আমাদের ক্লাবে পাড়ার কিছু দুষ্টু ছেলে ওঠাবসা করতো। একদিন শাহেদ ভাই তাদের একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, সে ক্লাবের সভাপতি, সেক্রেটারি, কোনও কর্মকর্তা, ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি খেলোয়াড় কি না। প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব না সূচক হওয়ায় তিনি ওই ছেলের কানধরে ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার পর দুষ্টু ছেলেদের ক্লাবে এসে আড্ডা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’
স্মরণ সভায় আলোচনাকালে ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘কাজী শাহেদ আহমেদের মাথায় সবসময়ই নতুন নতুন চিন্তা ছিল। কে জানতো পঞ্চগড়ে এমন একটা চা বাগান হবে। এমন একটা অর্গানিক টি স্টেটের কথা কেউ ভেবেছে! এই যে উদ্ভাবন, এই যে ঝুঁকি নেওয়া এমন সাহসী উদ্যোগ- কেবল কাজী শাহেদ আহমেদ বলেই সম্ভব হয়েছে।’
‘একসময় আমি তাকে কবি শামসুর রাহমানের দুরবস্থার কথা বলেছিলাম। তিনি সব শুনে খুব গোপনে কবির জন্যে প্রতি মাসে একটা সম্মানীর ব্যবস্থা করেন। এই বিষয়টি অনেকেই জানেন না।’
তিনি বলেন, ‘কাজী শাহেদের মাথায় শিক্ষা বিস্তারের নানা চিন্তা ছিল। তিনি বেশ আগেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন। সেখানকার ভিসিও ছিলেন সম্ভবত। আমি তাকে বলেছিলাম, ভাই- অনেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ব্যবসায় বিশ্ববিদ্যালয় করতে। আপনিও করেন, কিন্তু আমি মনে করি মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও মনোযোগ দেওয়া দরকার। উনি সেই কাজটিও করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা আর ইতিহাস না থাকলে দেশপ্রেমিক তৈরি হবে কীভাবে।’
জেমকন সাহিত্য পুরস্কারের সঙ্গে তরুণ পাণ্ডুলিপি রচয়িতাদের যে পুরস্কার দেওয়া হয়, তার নামকরণ ‘কাজী শাহেদ আহমেদ তরুণ লেখক পুরস্কার’ করার দাবি করেন মুনতাসীর মামুন।
সভায় ধন্যবাদ জ্ঞাপনকালে যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য, কাজী শাহেদ আহমেদের জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পরপরই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোক বার্তা দিয়েছেন। তার সন্তান হিসেবে আমরা তার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তার যে সততা, যে আদর্শ, দেশের প্রতি মমত্ব, দেশমাতৃকার প্রতি যে ভালবাসা, সেসব কিছু আমরা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করে কাজ করে যাবো।’
তিনি বলেন, ‘তার জীবনে একটা অপূর্ণতা ছিল- জনপ্রতিনিধি হওয়া, সেটি আমার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর যেদিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাই, দলীয় অফিস থেকে আমি, ছোট ভাই এনামসহ দলের লোকজন সেটি গ্রহণ করি। বাড়ি এসে আব্বাকে সেটি দিয়ে বলেছিলাম, ২০ বছর দেরি হয়ে গেছে; একটা নাম কেবল পরিবর্তন হয়েছে। তিনি সেই কপিটি স্ক্যান করে তার ঘরের দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘বাবা বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালবাসতেন; জননেত্রী শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ অনুসারী ও সহযোগী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীই বাবাকে অর্গানিক চা উৎপাদনে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার বাবা বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছেন, বিভিন্ন প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান করেছেন, রফতানিমুখি বিভিন্ন প্রোডাক্ট উৎপাদন করেছেন, নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, মিডিয়া বা প্রকাশনার সঙ্গে ছিলেন- আমরা তিন ভাই সবসময়ই চেষ্টা করবো তার সব কিছু ধারণ করে সেইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নিতে।’
অনুষ্ঠানে পরিবারের পক্ষ থেকে আলোচনাকালে কাজী শাহেদ আহমেদের মেজো ছেলে বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক ড. কাজী আনিস আহমেদ বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত কৌতূহলী মানুষ। তার কৌতূহল ছিল জ্ঞানের বিষয়ে, জানার বিষয়ে। তিনি সারাক্ষণ জানতে চাইতেন, শিখতে চাইতেন। তাকে যে শেখাতে পারবেন, জানাতে পারবেন- তিনি তার কাছে শুনতে চাইতেন। সেই ক্ষেত্রে তিনি কে বড় বা কে ছোট- এসব দ্বিধা করতেন না। সে কারণে আমার মনে হয়, এক জীবনে তিনি এতোগুলো জীবন ধারণ করে গেছেন।’
কাজী আনিস বলেন, ‘’বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, আর্মি অফিসার ছিলেন, ব্যবসায়ী ছিলেন, মিডিয়াতে ছিলেন, রাজনীতিতে ছিলেন, সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তিনি এত কিছুতে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন, তার কারণ তার জানার আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড।’
বাবা অনেক পড়াশোনা করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে আগ্রহের বিষয় সাহিত্য। আমি যখন শিক্ষার্থী, তখন নতুন কোনও বই পেলে আব্বুকে বলতাম, বইটা খুব ভালো। তিনি খুব বই পড়তেন। আমাকেও পাল্টা দিতেন পড়তে। সবশেষ তিনি আমাকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বই দেন পড়তে। এই বইটি আমার আগে জানা ছিল না। তিনি অত্যন্ত উদ্যমী, অকুতোভয়, আদর্শের বিষয়ে আপসহীন ছিলেন। এইসব গুণাবলীর সমন্বয়ে তিনি বারবার নতুন নতুন ক্ষেত্রে তার সীমা তৈরি করতেন।’
স্মরণসভায় আরও আলোচনা করেন- যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন, যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, জাসদের কার্যকরী সভাপতি রবিউল আলম, যশোর-২ আসনের সাবেক এমপি মনিরুল ইসলাম মনির, যশোর সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি একরাম-উদ-দ্দৌলা, শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি মাহবুবর রহমান মজনু, প্রেসক্লাব যশোরের সাধারণ সম্পাদক এস এম তৌহিদুর রহমান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- কাজী শাহেদ আহমেদের স্ত্রী আমিনা আহমেদ, ছোট ছেলে কাজী এনাম আহমেদ, পুত্রবধূ ডা. মালিহা মান্নান আহমেদসহ তার স্বজন, বন্ধু, যশোরের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।
গত ২৮ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কাজী শাহেদ আহমেদ। তিনি ১৯৪০ সালের ৭ নভেম্বর যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাসের পর ১৪ বছর সেনাবাহিনীতে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাকালীন প্লাটুন কমান্ডারদের একজন তিনি। বাংলাদেশে প্রকাশিত পত্রিকায় যে আধুনিকতার উপস্থিতি, তার শুরুই হয়েছিল কাজী শাহেদ আহমেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে।
১৯৭৯ সালে ‘জেমকন গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার ব্যবসায়ী জীবন শুরু। তিনি ছিলেন ‘খবরের কাগজ’ ও ‘আজকের কাগজ’-এর প্রকাশক ও সম্পাদক। বাংলাদেশে প্রথম অর্গানিক চা বাগানের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। এ ছাড়াও তার রয়েছে অসামান্য কিছু অলাভজনক উদ্যোগ। এর মধ্যে আছে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) ও কাজী শাহেদ ফাউন্ডেশন।
সাহিত্য পরিমণ্ডলেও কাজী শাহেদ আহমেদ সুপরিচিত। তার প্রথম গ্রন্থ ‘আমার লেখা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। সে বছরই ‘ঘরে আগুন লেগেছে’ নামে তার দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সালে ৭৩ বছর বয়সে তিনি রচনা করেন তার প্রথম উপন্যাস ‘ভৈরব’। আত্মজীবনী ‘জীবনের শিলালিপি’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। একই বছর প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘পাশা’। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘দাঁতে কাটা পেনসিল’। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘অপেক্ষা’। ইতোমধ্যে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ‘ভৈরব’।