দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ভালো নেই সাধারণ মানুষ। ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম। গত কয়েকদিন ইন্টারনেট না থাকায় সত্য-মিথ্যের মিশেলে ছড়াচ্ছে গুজব। মিলছে না প্রয়োজনীয় তথ্য। এতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে বাড়ছে ভীতি। অমানবিক কষ্টে জীবন ধারণ করছেন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থার দ্রুত উত্তরণে সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীসহ দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রত্যাশা সবকিছু কাটিয়ে আবারও স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে দেশ, স্বস্তি মিলবে মানুষের।
দেশজুড়ে চলছে কারফিউ। প্রশাসনকে সহায়তায় মাঠে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। রাজশাহী নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চলছে তল্লাশি। রাস্তায় সাধারণ মানুষ নেই বললেই চলে। যারা বেরিয়েছেন তারা নেহাতই বাধ্য হয়ে, জরুরি কাজে। এত নিরাপত্তা, তবুও গত কয়েকদিনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মনে বিরাজ করছে ভয় ও আতঙ্ক।
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন রাবেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘মোড়ে মোড়ে পুলিশ। আমরা গ্রামের মানুষ। এমনিতেই ভয়ে আছি। শহরে চিকিৎসা জন্য এসে আটকে গেছি। পদে পদে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জরুরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছিলাম। শহরে এসে আরও ভয় লাগছে। কখন যে কী হয়! এ অবস্থার দ্রুত অবসান হোক।’
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. আফরোজা নাজনীন বলেন, ‘দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সকলেই আতঙ্কে আছে। বিশেষ করে গ্রাম থেকে যারা চিকিৎসার জন্য আসছেন, তাদের মুখে ভীতি ও দুর্ভোগের কথা শুনতে পাচ্ছি। আমরা চিকিৎসক হিসেবেও যে ভয় বা আতঙ্কের মধ্যে নেই, এমনটা না। কিছুটা ভীতি আমাদের মধ্যেও আছে। কারণ, দেশের এ টালমাটাল পরিস্থিতি কখনোই কাম্য নয়। আমরা দ্রুতই এ অবস্থার উত্তরণে সকল পক্ষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এদিকে, চলমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপদে আছে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। এমনই একজন রিকশাচালক সাইরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একদিন রিকশা না চললে তার পরের দিন আর খাবার জোগানোর মতো অবস্থা আমার নাই। ঋণ করে একটা অটোরিকশা কিনেছিলাম। গত এক মাস আগে সে রিকশার ব্যাটারি চুরি হয়ে যায়। আবারও ঋণের টাকায় রিকশা চালু করলাম। এরপর দেশের এই পরিস্থিতি। একদিকে ঋণের বোঝা, অন্যদিকে চলমান পরিস্থিরির খড়্গ! দিশেহারা হয়ে পড়েছি। কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না।’
অপরদিকে, আগে থেকেই লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া। বর্তমান পরিস্থিতি আরেক দফা নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে সাধারণ মানুষকে। যদিও খাদ্যপণ্যের পরিবহণ কারফিউমুক্ত, তারপরও এই অজুহাতে দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। গত সপ্তাহে যে কাঁচা মরিচ আড়াইশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকায়। সবজির দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বেড়েছে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও।
সবজি বিক্রেতা জামশেদ আলী বলেন, ‘আমরা পাইকারিতে কিনে খুচরা বিক্রি করি। হাটেই মরিচের দাম বেশি। সেখানে প্রকারভেদে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দামে কিনতে হচ্ছে কাঁচা মরিচ। তাই প্রতি ১০০ গ্রাম ৪০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।’
ক্রেতা শাহিন বলেন, ‘ভ্যানে যে সবজি বিক্রি হয় তার দাম সব সময় বেশি। খড়খড়ি বাইপাসে যে মরিচ ৩০০ টাকা কেজি। ভ্যানে একই মরিচ বিক্রি করা হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজি দরে। বিক্রেতারা কেজিতে ১০০ টাকা লাভ করছে। তাদের দাবি, মরিচ মাপার সময় কমে যায়। তাই তারা প্রতি ১০০ গ্রাম মরিচ বিক্রি করছেন ৪০ টাকায়।’
গৃহিণী শাকিলা ইসলাম বলেন, ‘আমাদের রাজশাহীতেই প্রচুর মরিচ উৎপাদন হয়। সেই মরিচগুলো এখন রাজশাহীতেই কেনা-বেচা হচ্ছে। কারণ, সারা দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ। তাহলে তো মরিচের দাম বাড়ার কথা না। কিন্তু সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা মরিচের দাম বাড়িয়েছেন। এবার সেভাবে বৃষ্টিপাত হয়নি যে মরিচের গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে।’
পাইকারি বিক্রেতা আব্দুস সালাম বলেন, ‘মরিচের দাম বেড়েছে। বর্ষার কারণে মরিচের গাছ নষ্ট হওয়ায় ফলন কমে গেছে। তাই চাষিরা কাঙ্ক্ষিত মরিচ পাচ্ছেন না। এ ছাড়া মরিচের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। তাই দাম বেড়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এবার রাজশাহীতে তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। তারপরেও যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতে কিছু মরিচের গাছ মারা গেছে। তবে এ বছর মরিচের ফলন ভালো হয়েছে।’
ভীষণ কষ্টে দিন যাপন করছেন সাধারণ শ্রমিকেরা। আজিজুল ইসলাম পেশায় বাসচালক। গ্রামীণ ট্রাভেলসের কক্সবাজারে গাড়ি চালান। তিনি বলেন, ‘গেলো সপ্তাহে কক্সবাজার থেকে এসে নেমেছি। বুধবার (২৪ জুলাই) আবার কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। যদিও আমাদের শ্রমের দাম খুব কম। ট্রিপপ্রতি বেতন দেওয়া হয়। তবে যেটুকু দেওয়া হয় তা দিয়ে সংসার খরচ চলে যায়। কিন্তু এখন গাড়ি না চললে আমাদের সংসারও চলছে না। প্রায় এক সপ্তাহ থেকে বসে আছি। কারফিউ তুলে নিয়ে কত দিনে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে সেটাও দেখার বিষয়।’
রাজশাহী পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. সাজু বলেন, ‘আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা খুব কষ্টে আছেন, তা জানি। তাদের নিয়মিত খোঁজখবরও নেওয়া হচ্ছে। আমাদের গাড়ির চাকা ঘুরলেই টাকা পাওয়া যাবে। যদি কারফিউ দীর্ঘ সময় থাকে তাহলে তাদের সহযোগিতা করা হবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির অবস্থা অনেকটাই টালমাটাল। আর রাজশাহী হলো শিক্ষা নগরী। এখানকার অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা বড় অংশ শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে। সে শিক্ষার্থীরা সবাই চলে গেছে। এর পাশাপাশি দেশজুড়ে কারফিউ চলছে। কৃষক বিক্রি করতে পারছে না। অথচ আমাদের কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বলা চলে শহর প্রায় অচল হয়ে গেছে। এখন রাজশাহীর ব্যবসায়ীরা পুঁজি ভেঙে জীবন ধারণ করছেন। আর যেকোনও দেশের অর্থনীতির ভিত হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশের ফ্রিল্যান্সাররাও বিপাকে পড়েছেন। অনেক গুজবও ছড়াচ্ছে। এ অবস্থার উত্তরণ জরুরিভিত্তিতে করতে হবে। দেশের সরকারপ্রধানও সে তাগিদ দিয়েছেন।’
এদিকে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহান (১৩) বলে, ‘কারফিউয়ের কারণে স্কুল বন্ধ। একই সঙ্গে কোচিং ও প্রাইভেট বন্ধ আছে। যে ভাইয়া প্রাইভেট পড়াতে আসতেন তিনিও বাড়িতে চলে গেছেন। এখন অনেক সময় পাওয়া যাচ্ছে। সকালে পড়াশোনা শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করা হচ্ছে। এরপর পুকুরে এসে গোসল করে আবার বাড়িতে গিয়ে বিকালে খেলতে বের হচ্ছি। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে আবার পড়াশোনা করতে হচ্ছে। স্কুল খুললে হয়তো এমন সময় পাওয়া যেত না।’
আরেক শিক্ষার্থী সিয়াম বলেন, ‘স্কুল খোলা থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করা হতো না। এখন অনেক সময় পাওয়া যাচ্ছে খেলাধুলা করার জন্য। এ সময় কোচিংও বন্ধ আছে। হয়তো কারফিউ না থাকলে এমন সময় পাওয়া যেত না। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে ভালোই লাগছে। এতে সময় ভালো কাটছে।’
কারফিউ জারির মধ্যে অনেকে রাস্তায় ক্রিকেট-ফুটবল নিয়ে খেলতে নামছেন। তবে এখানে শিশু-কিশোররা না মধ্যবয়সী মানুষরা খেলাধুলা করছেন। বিকালে কেউ কেউ ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছেন। নগরীর অলোকার মোড়ে সোমবার সকালে যুবকদের ক্রিকেট খেলতে দেখা যায়। সেখানে ইসমাইল হোসেন নামের একজন বলেন, ‘রাজশাহীতে ২০ বছর আগেও অনেক মাঠ ছিল। এখন মাঠ নেই বললেই চলে। এজন্য আমাদের শিশু-কিশোররা মাঠে না খেলে অনলাইন গেমিং ও মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের হাতে এখন কাজ নেই বলে আমরা রাস্তাতেই খেলাধুলা করছি। পুলিশের টহল গাড়ি গেলেও আমাদের কিছু বলছে না।’