বাণিজ্যিকভাবে গাজীপুরে চাষ হচ্ছে স্ট্রবেরি। বেশি ফলন হলে অধিক লাভ ও উচ্চ বাজারমূল্যের কারণে স্ট্রবেরি চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। এখানে অনেকেই এক যুগের বেশি সময় ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছেন। পেয়েছেন সফলতা। নতুন করে কেউ চাষ করতে চাইলে চাষিদের মুখেই শুনুন সফলতা ও চ্যালেঞ্জের গল্প।
গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়া উপজেলার দুটি গ্রামে স্ট্রবেরি চাষ হয়। শ্রীপুরের বরামা এবং কাপাসিয়ার সিংহশ্রী এলাকায় এই চাষের বিস্তৃতি ঘটছে।
শ্রীপুরের বরমী ইউনিয়নের বরামা গ্রামের মো. রুবেল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন। তিনি স্ট্রবেরি চাষ করে সফল হয়েছেন। রুবেল জানান, ছয় বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করেন। অন্যান্য বার ৫ কাঠা জমিতে চাষ করতেন। প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে প্রায় তিনগুণ লাভ হওয়ায় এবার ৭ কাঠা জামিতে চাষ করেন। কিন্তু এবার তার জমিতে রোপণ করা সেঞ্চুয়েশন জাতের স্ট্রবেরি চারা গাছে ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। গাছে শেকড় পচা রোগ দেখা দিয়েছে। আক্রান্তের দুই-তিন দিনের মধ্যে গাছের পাতা কালো হয়ে যাচ্ছে। ওসব গাছের অর্ধেক শেকড় পচে গেছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহারের পরও সুফল পাচ্ছেন না। সেঞ্চুয়েশন জাতের স্ট্রবেরি চারা গাছে পাতা কালো হয়ে যাওয়া ও শেকড় পচা রোগ দেখা দেয়। এই জাতের চারা গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। যদিও গত ৫ বছরে ফেস্টিভাল চারা লাগিয়ে তিনগুণ আয় করেছেন তিনি।
বরামা গ্রামের আব্দুস ছাত্তারের ছেলে সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি ১১ বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছেন। প্রতিবেশী মোশারফ হোসেনের স্ট্রবেরি চাষাবাদ দেখে চাষাবাদ শুরু করেছিলেন। প্রথমে রাবি-৩ জাতের স্ট্রবেরি আধা কাঠা জমিতে চাষ করেন। এতে তার ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয়। পরের বছর ফেস্টিভাল নামে আরও একটি জাতের চাষ করেন। লাভজনক হওয়ায় দ্বিতীয় বছর চার কাঠা জমিতে চাষ করেন। চার কাঠা থেকে উৎপাদিত স্ট্রবেরি সাড়ে তিন লাখ টাকা বিক্রি করেন। দ্বিতীয় বছরে নিজেই চারা সংরক্ষণ করেন। এভাবে বছরের পর বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করে সফল তিনি। এবছর সাত কাঠা জমিতে চাষ করেছেন। তার গাছে কোনও সমস্যা নেই।
সাইফুল ইসলাম বলেন, উইন্টারডন জাতের স্ট্রবেরি চারা গাছ গাজীপুরের পরিবেশের সঙ্গে ভালো ফলন দেয়। এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি, ফলের রঙ উজ্জ্বল এবং আগে উৎপাদন হয়। ফেস্টিভাল জাত দেরিতে উৎপাদন হয়। ফলে বৃষ্টি ও বিরূপ আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উইন্টারডন জাতের একটি চারা গাছ থেকে মৌসুমে কমপক্ষে দুই কেজি ফল পাওয়া যায়। চার কাঠা জমিতে ৫ হাজার স্ট্রবেরি চারা রোপণ করা যায়। এক কাঠা জমিতে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়।
তিনি বলেন, কার্তিক মাসে জমিতে রোপণ করতে হয়। পৌষের মাঝামাঝি সময় থেকে ফলন আসে। চৈত্র মাস পর্যন্ত ফল বিক্রি করা যায়। গত বছর দুই লাখ টাকা খরচ করে ৫ কাঠা জমি থেকে ৬ লাখ টাকার স্ট্রবেরি বিক্রি করেছি। এবার ৭ কাঠা জমি থেকে আরও বেশি আয়ের প্রত্যাশা রয়েছে আমার।
প্রতিদিন সকালে ১৮ থেকে ২০ কেজি স্ট্রবেরি সংগ্রহ করেন সাইফুল। পাখি ছাড়া ক্ষতি করার মতো প্রাণী নেই। নিজের সংগৃহীত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে সার, কীটনাশক প্রয়োগ করেন। কৃষি বিভাগের লোকজন তার চাষ দেখতে আসেন। কিন্তু তাদের পরামর্শ স্ট্রবেরি চাষের জন্য যথাযথ নয়।
চাষিদের পরামর্শ দিয়ে সাইফুল বলেন, সেঞ্চুয়েশন জাতের স্ট্রবেরি চারা গাছের জাত চাষ করে এলাকার অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়। তাই এই জাত বাদ দিয়ে ভিন্ন জাতের স্ট্রবেরি গাছের চারা চাষাবাদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এই এলাকার চাষিরা আব্দুল্লাহপুর, কারওয়ান বাজার, গাজীপুরের বাইপাস, প্রভৃতি এলাকায় স্ট্রবেরি বিক্রি করেন। প্রতি কেজি ৭০০ টাকায় বিক্রি করেন তারা।
স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইসরাফিল হোসেন বলেন, ১৬ বছর আগে ছেলে মোশাররফ হোসেন ময়মনসিংহ থেকে স্ট্রবেরি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নেয়। কিন্তু তখন দেশে স্ট্রবেরির জাত আসেনি। দুই বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক হাজার স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করে। ওই বছর রোপণ করে। এলাকা ও সারাদেশে তার স্ট্রবেরি চাষের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তাকে দেখে আশপাশের অনেকে চাষে উৎসাহিত হন। এখন বরামা দক্ষিণপাড়া গ্রামটি স্ট্রবেরি চাষের গ্রাম হিসেবে পরিচিত।
ওই গ্রামের চাষি ইমাম উদ্দিন বলেন, এবার সেঞ্চুয়েশন জাতের স্ট্রবেরি চারা লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তিন লাখ টাকা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কোনও উপায় নেই।
একই এলাকার চাষি দুদু মিয়া বলেন, স্ট্রবেরি চাষ লাভজনক। বছরে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা লাভ হয়।
কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী এলাকার চাষি মিফাত হোসেন বলেন, পাঁচ বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছি। এই চাষ প্রায় চার মাস মেয়াদি। কিন্তু লাভজনক। চার মাস পরিশ্রম করলে তিনগুণ লাভ করা সম্ভব। এখন রাজশাহী থেকে স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করতে হয় না। এলাকাতেই চারা পাওয়া যায়। এক কাঠা জমিতে এক হাজার চারা রোপণ করা যায়। জমিতে রোপণের খরচসহ একেকটি চারার পেছনে খরচ হয় ৪০ টাকা।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী ও শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের দক্ষিণ বরামা গ্রামের কয়েকজন চাষি স্ট্রবেরি চাষ করছেন। দ্রুত পচনশীল হলেও এটি অধিক লাভজনক। সাধারণত ছত্রাকের আক্রমণ ছাড়া অন্য কোনও ধরনের সমস্যা হয় না। ছত্রাক থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনমতো ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে রোগবালাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।