ব্রহ্মপুত্রের পর দুধকুমার ও ধরলার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়েছে আট উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের লাখো মানুষ। পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দি থেকে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র ও বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। শুকনো স্থানের অভাবে রান্নার কষ্টে দিনাতিপাত করা বানভাসিরা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন।
শনিবার সকালে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙা ইউনিয়নে দুধকুমার নদের একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ‘বাঁধ’ ভেঙে কমপক্ষে ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, ভেঙে যাওয়া অংশটি তাদের বাঁধ নয়, নদের তীরের একটি গ্রামীণ সড়ক।
বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রনি জানান, শনিবার সকালে ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড এলাকায় পাউবোর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দুটি অংশ দুধকুমার নদের পানির চাপে ভেঙে গেছে। পানি প্রবেশ করে মিয়াপাড়া, পাটেশ্বরী, মনিটারী, সর্দারটারী, আদর্শ বাজার, সেনপাড়াসহ ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে হাজারো মানুষ।
পাউবো কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘ভেঙে যাওয়া অংশটি পাউবোর বাঁধ নয়। সেটি মূলত একটি গ্রামীণ সড়ক। গত বছরও সেটি ভেঙে গেলে আমরা কিছু জিও ব্যাগ দিয়ে মেরামত করেছিলাম। শনিবার আবারও ওই সড়কটির কিছু অংশ ভেঙে গেছে।’
সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে জেলায় বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হওয়ায় ৩৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণি পাঠদান ও পরীক্ষা স্থগিত করেছে শিক্ষা বিভাগ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, জেলায় ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে ধরলা ও দুধকুমার নদীও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। শনিবার (৬ জুলাই) দিনভর ব্রহ্মপুত্রের পানি সামান্য কমলেও এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টায় এই নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৫৮ সেন্টিমিটার এবং হাতিয়া পয়েন্টে ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই সময়ে ধরলা নদীর পানি বেড়ে কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং দুধকুমার নদের পানি বেড়ে পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার প্রতিবেদন বলছে, শনিবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে জেলার আট উপজেলার ৫৩২ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সরকারি হিসাবেই ৮৪ হাজার ২৫২ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।
জেলার সদর, নাগেশ্বরী, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলায় পানিবন্দি মানুষজন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গৃহপালিত প্রাণী নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বানভাসিরা। গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চরে অর্ধনিমজ্জিত শন আর কলাপাতা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন বানভাসীরা। গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ঘরের ভেতর খাট কিংবা মাচান তৈরি করে কোনোমতে অবস্থান করছেন দুর্গত লোকজন। গত পাঁচ দিন ধরে নারী ও শিশুদের জীবন ঘরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
শিক্ষা বিভাগ বলছে, জেলার ২৯০টি প্রাথমিক ও ৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৬টি মাদ্রাসা এবং ৬টি কলেজ প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬টি কলেজে শ্রেণি পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও ৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৩৬টি মাদ্রাসায় চলমান ষান্মাসিক পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। ৮টি মাধ্যমিক ও ৩২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দুর্গত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা বিতরণ শুরু করেছে মাঠ প্রশাসন। শনিবার পর্যন্ত ২৯১ মেট্রিক টন চাল এবং ১৫ হাজার ৩২০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা বিতরণ চলমান রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে জেলায় তৎপরতা চালানো ৭১টি এনজিও প্রতিষ্ঠানকে বানভাসিদের পাশে দেখা যায়নি। দুর্গত এলাকায় তাদের উপস্থিতি কিংবা সহায়তা বিতরণের কোনও খবর স্থানীয় প্রশাসনের কাছেও নেই। এ অবস্থায় তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সচেতন মহল।
সচেতন নাগরিকদের সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুড়িগ্রামের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল কাদের বলেন, ‘দরিদ্রতাকে পুঁজি করে এ জেলায় এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম চালায়। কিন্তু বন্যার সময় তাদের দুর্গত মানুষের পাশে দেখা যাচ্ছে না। জনগণের জন্য কাজ করার নামে তারা কী করছে, তাদের আয়-ব্যয়সহ কার্যক্রম খতিয়ে দেখা উচিত।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। তবে জেলায় কার্যক্রম চালানো এনজিওগুলোর দুর্গত মানুষদের সহায়তা করার কোনও দৃশ্যমান কার্যক্রম আমার নজরে আসেনি। তারা কেউ কোনও রিপোর্টও করেননি। তাদের ডাকা হয়েছে। দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য তারা কে কী করছেন তা জানতে চাইবো।’ তবে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ দুর্গতদের জন্য বিভিন্ন সহায়তা দিয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।