বাঁধ ভেঙে প্লাবিত গোমতী তীরের উপজেলা কুমিল্লার বুড়িচং। কিন্তু অনেকে জানে না বুড়িচং ছাড়াও জেলার আরও সাত উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। অনেক এলাকার অবস্থা বুড়িচং থেকেও ভয়াবহ। যেখানে নেই আশ্রয়কেন্দ্র। যাচ্ছে না ত্রাণ সহযোগিতা। সব মিলিয়ে জেলায় ১০ লাখ ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন।
এর মধ্যে বুড়িচং উপজেলায় এক লাখ ৭৫ হাজার মানুষ, মনোহরগঞ্জ উপজেলায় এক লাখ ৮০ হাজার, নাঙ্গলকোট উপজেলায় এক লাখ ৭৫ হাজার, চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় এক লাখ ৯০ হাজার, লাকসামে এক লাখ ৫০ হাজার, ব্রাহ্মণপাড়ায় এক লাখ ৫০ হাজার এবং বরুড়ার ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯ আগস্ট গোমতীর বাঁধ বেঙে প্লাবিত হয় বুড়িচং। সেই পানি ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলায় ছড়িয়ে বেশিরভাগ গ্রাম ডুবে যায়। অপরদিকে মুহুরী নদীর পানিতে ডুবেছে ফেনী। একই পানিতে ডুবেছে চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট ও বরুড়া উপজেলার বেশিরভাগ অংশ।
বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে পানিবন্দি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুড়িচংয়ের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রপত্রিকা ও স্থানীয়দের মাঝে বেশি পরিমাণে আলোচিত হওয়ায় বাদ পড়ছে জেলার বাকি সাত উপজেলার পানিবন্দি মানুষের কথা। এতে করে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা বুড়িচং ও কিছু অংশ ব্রাহ্মণপাড়া গেলেও বাকি ছয় উপজেলায় যাচ্ছে না। ফলে অনেকে খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছেন।
ঢলের পানিতে ডুবে গেছে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ১০ ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম। এর মধ্যে গুণবতী, আলকরা, মুন্সিরহাট, কনকাপৈত, শুভপুর ও চিওড়া ইউনিয়নের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। এসব ইউনিয়নের সব গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি অবস্থায় আছেন এসব গ্রামের বাসিন্দারা।
দুর্ভোগের কথা জানিয়ে চৌদ্দগ্রামের চিওড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ডুবে গেছে। সবাই পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। তবে তেমন কোনও ত্রাণ আসছে না। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে দেখা যায়নি। অথচ এখানের অবস্থা ফেনীর মতো। সরকারি সহযোগিতা যা আসছে, তা সবাই পাচ্ছেন না। সবার প্রতি অনুরোধ, চৌদ্দগ্রামের দিকে আসুন।’
সবার কাছে ত্রাণ না পৌঁছানোর কথা স্বীকার করে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রহমত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপজেলায় এক লাখ ৯০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। আমাদের কাছে ২০ হাজারের মতো শুকনো খাবারের প্যাকেট আছে। প্রতিদিন আমরা চৌদ্দগ্রাম মডেল মসজিদের সামনে দেড় থেকে দুই হাজার মানুষের খাবারের আয়োজন করছি। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী এসে বন্যাকবলিতদের মাঝে খাবার বিতরণ করছেন। তবে সেটি বুড়িচংয়ের মতো বেশি নয়। এখানে আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।’
লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এই উপজেলার আট ইউনিয়নের সব কটি প্লাবিত হয়েছে। সেখানে ৮২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ আছেন। এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। তবে সরকারি ত্রাণ সহযোগিতা পেয়েছেন মাত্র ৪০ হাজার মানুষজন। অনেকে পাননি।
এ ব্যাপারে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হাই সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে আরও মানুষের জন্য প্রচুর সহযোগিতা প্রয়োজন। এই ত্রাণ যথেষ্ট নয়।’
চৌদ্দগ্রাম ও বুড়িচংয়ের পর বেশি প্লাবিত এলাকা মনোহরগঞ্জ। এখানে এখনও তেমন ত্রাণ পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ, প্রচারণা কম থাকায় ব্যক্তি ও সংগঠনকেন্দ্রিক ত্রাণ আসেনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা একেবারেই নোয়াখালীর পাশে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারাই ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কুমিল্লায় আসছেন, তাদের সবাই বুড়িচং কিংবা আশপাশের উপজেলায় যাচ্ছেন। মহাসড়ক থেকে দূরের উপজেলা হওয়ায় নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জের বানভাসিদের কাছে যাচ্ছেন না কেউ। কিন্তু ডাকাতিয়া নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে এই উপজেলার বেশিরভাগ গ্রাম।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা এমরান হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানের বেশিরভাগ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় খুব কষ্টে আছেন। তাদের উদ্ধার করতে নৌকা ও স্পিডবোট দরকার। এখনও ত্রাণ আসেনি।’
মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, ‘এখানে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। আজও পানি বেড়েছে। উপজেলার অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে, যেগুলোতে নৌকা ছাড়া যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমাদের কাছে নৌকার সংকট আছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পাঠিয়ে সেসব এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন একজন মানুষও অভুক্ত না থাকে।’
নাঙ্গলকোটের অবস্থা চৌদ্দগ্রামের মতোই। অথচ ত্রাণ যায় নোয়াখালী ও ফেনীতে। নাঙ্গলকোটের দিকে তেমন কেউ নজর দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
স্থানীয়দের ভাষ্য, নাঙ্গলকোট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার অধিকাংশ এলাকায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি আছেন। গ্রামীণ অধিকাংশ সড়ক ও ফসলি মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। উঁচু জমিতে করা আমন ধানের বীজতলা পানিতে ডুবে গেছে। ভেসে গেছে পুরো উপজেলার পুকুর ও খামারের মাছ। ক্ষতির মুখে পড়েছে পোলট্রি শিল্প। পানিতে তলিয়ে পৌরসভার দাউদপুর গ্রামের কেরামত আলী নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। বিশেষ করে উপজেলার সাতবাড়িয়া, বক্সগঞ্জ, ঢালুয়া, মৌকারা, রায়কোট উত্তর, রায়কোট দক্ষিণ, জোড্ডা পূর্ব, জোড্ডা পশ্চিম, আদ্রা উত্তর, আদ্রা দক্ষিণ, বাঙ্গড্ডা ও পেরিয়া ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন।
জানা যায়, উপজেলার ঢালুয়া-চিওড়া ও বক্সগঞ্জ-গুনবতী আঞ্চলিক সড়কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নৌকায় করে দুর্গত মানুষকে উদ্ধার করে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখনও পানিবন্দি। বন্যার পাশাপাশি পুরো উপজেলা নেই বিদ্যুৎ। পানিবন্দি মানুষের রান্না করার অসুবিধার কারণে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি অসুবিধার মুখে পড়েছেন বৃদ্ধ, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিরা।
নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, ‘টানা বৃষ্টির ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে নাঙ্গলকোট উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যার্ত মানুষকে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উপজেলার সাতবাড়িয়া, বক্সগঞ্জ, মৌকরা, রায়কোট, জোড্ডা পূর্ব, জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়নে এক মেট্রিক টন করে চাল সহায়তা দেওয়া হয়েছে। শুকনা খাবারের জন্য চাহিদা দেওয়া হয়েছে। পেলে বিতরণ করা হবে। চাহিদা অনেক বেশি। লাখো মানুষের চাহিদা। কিন্তু ত্রাণ আসছে খুবই কম।’
একই কথা বলেছেন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই উপজেলার ২৮ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা কাজ করছি। তবে চাহিদা অনেক বেশি। নৌকা ও খাবার পানি দরকার। সঙ্গে শুকনো ও রান্না করা খাবারের চাহিদা বেশি।
তিনি আরও বলেন, কিছু এলাকায় মানুষ আটকে আছে। তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। এই উপজেলায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে রয়েছেন। লাখো মানুষ পানিবন্দি আছেন। মূলত গোমতীর পানিতেই এই উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।
বরুড়ার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন, পয়ালগাছা, গালিমপুরসহ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করলেও তেমন কোনও ত্রাণ সহযোগিতা পাচ্ছেন না বন্যাদুর্গতরা। উপজেলা প্রশাসন থেকে আশ্রয়কেন্দ্র ও একাধিক স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা খুব কম বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নু-এমং মারমা মং বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপজেলার বন্যাদুর্গত গ্রামগুলোতে ত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। তবে আমাদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী ও বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। সবাই একযোগে কাজ করলে পরিস্থিতি মোকাবিলা সহজ হবে।’