২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে চালানো গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশিদ। সেদিন মানবপ্রাচীর তৈরি করে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে রক্ষা করেন। তবে ছেলে হারানোর ব্যথা আজও বুকে নিয়ে দিনযাপন করছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। মৃত্যুর আগে খুনিদের বিচার দেখে যেতে চান। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এটিই এখন তাদের একমাত্র চাওয়া।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জয়ন্তীহাজরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের একসময় বিড়ি তৈরির কারিগর হারুন অর রশিদের দ্বিতীয় ছেলে মাহবুবুর রশিদ। ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করা মাহবুবের বাড়ির পাশের স্থানীয় ফুলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর পাশের উপজেলা পাংশার বাহাদুরপুর শহীদ খবির উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাস করেন।
নিজের চেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক পদে যোগদান করেন। এতে দরিদ্র বাবার সংসারে আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠে। চাকরি করে পাঁচ বোনের মধ্যে তিন জনকে বিয়েও দেন। ছোটদের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। সতীর্থ সৈনিকদের মাধ্যমে খবর পেয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে যোগ দেন। বিশ্বস্ততা অর্জন করায় অল্প সময়ের মধ্যে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর নিরাপত্তারক্ষী হয়ে যান।
ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তি দেখে যেতে চান মাহবুবের বাবা-মা
শনিবার মাহবুবুরের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জয়ন্তীহাজরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছেন মা হাসিনা বেগম (৭০)। ঘরের বারান্দায় ছেলের ছবির পাশেই বসে আছেন বাবা হারুন অর রশিদ (৮৪)। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তাদের শরীরে দানা বেঁধেছে নানা রোগ।
এই বৃদ্ধ দম্পতির ১০ সন্তানের মধ্যে মেজো ছিলেন মাহবুবুর রশিদ। বড় ছেলে জন্মের দুই বছরের মধ্যে মারা যায়। তাই রশিদই ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তিনি। এই বৃদ্ধ দম্পতির চোখে আজও অমলিন ছেলের স্মৃতি। হারানো ছেলের স্মৃতি আজও তারা বুকে লালন করে চলেছেন।
১৯ বছর আগে এই ছেলের নিহত হবার খবর শোনার পর মায়ের বুক কেঁপে উঠেছিল। নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন বাবা। সেই শোক আজও তাজা। ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তারা। তাদের আশা, মৃত্যুর আগে হত্যাকারীদের শাস্তি যেন দেখে যেতে চান।
জানতে চাইলে কথা প্রসঙ্গে মাহবুবের বাবা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এত দিন হয়ে গেলো খুনিদের শাস্তি হলো না। শরীরে অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট। মাসে প্রায় ১৫-১৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। মৃত্যুর আগে খুনিদের শাস্তি দেখে যেতে চাই। না হয় আমার আল্লাহই খুনিদের বিচার করবে। এখন আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিছি বিচার। মাহবুব ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। সেই ছেলেকে হারিয়ে দুঃখ ১২ মাস।’ তবে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে ছেলের জীবন চলে যাওয়াকে তিনি শহীদ হিসেবে দেখছেন।
মা হাসিনা বেগম জানান, ‘শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো না। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে ওঠে। বয়সের ভারে এখন আর বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি না। কষ্ট ও জ্বালা নিয়ে আছি। প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোনও খবর রাখেন না। প্রতি বছরের মতো এবারও ছেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাড়িতে মিলাদ-মাহফিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতি মাসে কল্যাণ ফান্ড থেকে যে টাকা দেওয়া হয় তা এবং এক মেয়ের পাঠানো টাকা দিয়ে দুজনের সংসার কোনও রকমে চলে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া বাড়িতে গাভীর দুধ বিক্রি করে ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখি। গ্রামের বাড়িতে শুধু আমরাই বাস করি। প্রতি ২১ আগস্টের সপ্তাহখানেক আগে থেকে এই বাড়িতে সাংবাদিকরা হাজির হন। কিন্তু ছেলেকে হাজির করতে পারে না কেউ। তবু আশায় বুক বেঁধে আছি ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর যেন দেখে যেতে পারি। সেই খবর শোনার অপেক্ষায় আছি।’
বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী, আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।