নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কারোড এলাকায় ১২ ডিসেম্বর ‘ছিনতাইকারীর’ ছুরিকাঘাতে নিহত হন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থী মো. ওয়াজেদ সীমান্ত (২০)। মোবাইল ও টাকা ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও স্বজনরা বলছেন, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কারণ সীমান্তের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও অংশ নিয়েছেন সীমান্ত। তবে সংগঠনের কোনও পদে ছিলেন না।
ওয়াজেদ সীমান্ত দেওভোগ পাক্কারোড এলাকার মো. আলম পারভেজের ছেলে এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ছাত্র। ১২ ডিসেম্বর সকালে ডিআইটি আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগারের সামনে তাকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা। ওই দিন রাত সোয়া ১০টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
পুলিশ বলছে, ১২ ডিসেম্বর ভোরে ওয়াজেদ সীমান্ত দেওভোগের বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হন। সকাল ৬টার দিকে বাড়ির পাশের ডিআইটি আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগারের সামনে তার কাছ থেকে মোবাইল ও এক হাজার ৮০০ টাকা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এতে বাধা দিলে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর অবস্থায় প্রথমে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় অনিক (২৮) নামে এক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়। সে নগরের সুকুমপট্টি এলাকার নয়নের ছেলে। তার কাছ থেকে নিহতের মোবাইল ফোন ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। অনিকের বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতি চেষ্টা ও মাদকসহ আটটি মামলা এবং দুটি গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। পুলিশের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা অনিক।
সীমান্তের স্বজনরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন সীমান্ত। তবে সংগঠনের কোনও পদে ছিলেন না। তার কিংবা পরিবারের সঙ্গে কারও কোনও বিরোধ ছিল না। তবে তাদের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকালে দেওভোগ পাক্কারোড এলাকার বাসায় গেলে এসব তথ্য জানিয়েছেন সীমান্তের স্বজনরা।
সীমান্তের মৃত্যুর পর থেকে এখনও কেঁদে যাচ্ছেন মা রেহেনা আলম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে। এর মধ্যে ছেলে বড়। সে এসএসসি ও এইচএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ভালো ফল করেছিল। খুব মেধাবী ছাত্র। কখনও বাইরে আড্ডা দিতে যেতো না। বিশ্ববিদ্যালয় আর বাড়িতে পড়াশোনা করে সময় কাটতো। বাইরে কারও সঙ্গে মিশতো না। বন্ধু-বান্ধব ছিল না। সারাক্ষণ লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শুরুতে আমি তাকে বাসার বাইরে যেতে দিইনি উল্লেখ করে রেহেনা আলম বলেন, ‘তবে শেষের দিকে আন্দোলনে যোগ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকায় ঢাকায় গিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেয়। তবে একেবারেই সক্রিয় ছিল, এমন নয়। কোনও পদে ছিল না। আগস্টে যখন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন নিষেধ করায় আর আন্দোলনে যায়নি। আমাদের একমাত্র ছেলে। তাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের সঙ্গে কারও কোনও বিরোধ ছিল না। তবু ছেলেকে এভাবে চলে যেতে হবে কখনও ভাবিনি। কারা কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে হত্যা করেছি কিনা, তাও জানি না। তবে আমি ছেলে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। যাতে আর কোনও মায়ের কোল খালি না হয়।’
ছেলের স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে উল্লেখ করে সীমান্তের মা বলেন, ‘ছেলের স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় পড়তে যাবে। সেখানে পড়াশোনা ও চাকরি করে স্থায়ী হবে। আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে। বলেছিল টাকা জমিয়ে আমাকে হজে নিয়ে যাবে। প্রায় সময় হজে যাওয়ার কথা বলতো। একটা স্বপ্নও ছেলের পূরণ হলো না।’
নব্বইয়ের দশক থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছেন সীমান্তের বাবা আলম পারভেজ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের রাজনৈতিক কোনও শত্রু নেই। ছেলে এবং আমরা খুব সাদামাটা জীবন যাপন করছি। রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত বাবদ ছেলেকে প্রতিদিন ২০৫ টাকা দিতাম। সে খুব মিশুক ছিল। কারও সঙ্গে কোনও বিরোধ ছিল না। এমনকি আমাদের কারও সঙ্গে বিরোধ নেই। কারণ আমি কখনও কারও ক্ষতি করিনি। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে বিএনপিতে আমার কোনও পদ নেই। এখন হয়তো কেউ শত্রুতা করে ছেলেকে হত্যা করলেও করতে পারে।’
সীমান্তের প্রতিবেশী শান্ত জানিয়েছেন, সীমান্ত খুব ভালো ছেলে। তাকে এলাকায় কখনও আড্ডা দিতে দেখিনি। সব সময় মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেখেছি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়টাতেও মাঝেমধ্যে বাড়িতে দেখেছি। তবে এখানে কোনও আন্দোলনে অংশ নিতে দেখিনি।’
এ ঘটনায় ১৫ ডিসেম্বর সীমান্তের বাবা অজ্ঞাতদের আসামিকে করে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন। বুধবার আকাশ নামে আরও এক আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলায় এখন পর্যন্ত দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে অনিক গ্রেফতারের পর ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে কীভাবে সীমান্তকে ছুরিকাঘাত করেছে, তার বর্ণনা আমাদের কাছে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতি চেষ্টা ও মাদকসহ আটটি মামলা আছে। নতুন করে হত্যা মামলা যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি বুধবার রাতে আকাশ নামে আরেক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ছিনতাই ও চুরিসহ মোট ১১টি মামলা রয়েছে। তারা দুজনে বৃহস্পতিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনয় আরও কয়েকজন জড়িত আছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’
ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে আসামিরা জানিয়েছে উল্লেখ করে এসআই রফিকুল আরও বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যেটুকু পেয়েছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে তার কিংবা পরিবারের সঙ্গে আসামিদের পূর্ববিরোধ ছিল না। শুধুমাত্র ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ঘটনাটি ঘটনানো হয়েছে।’
একই কথা বলেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্তি পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘কোনও পূর্ববিরোধ ছিল না। বুধবার আকাশ নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে হত্যায় জড়িত দুই আসামিকে গ্রেফতা করেছে পুলিশ। তারা জানিয়েছে, মানিব্যাগ টানানানি নিয়ে সীমান্তকে ছুরিকাঘাত করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আমাদের জানিয়েছে, সীমান্ত কিংবা তার পরিবারের সঙ্গে পূর্ব কোনও বিরোধ ছিল না। আমরাও তদন্তে পাইনি।’