কোটা আন্দোলন ঘিরে নারায়ণগঞ্জে ৫ দিনে যা ঘটেছে
বাংলাদেশ

কোটা আন্দোলন ঘিরে নারায়ণগঞ্জে ৫ দিনে যা ঘটেছে

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৮ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে নারায়ণগঞ্জে একপ্রকার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই সময়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভরতদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপে অন্তত আট জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন চার শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। অনেকে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন।

হাসপাতাল ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮ জুলাই আহত শতাধিক, ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধসহ আহত শতাধিক, ২০ জুলাই চার জন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ আহত দেড় শতাধিক, ২১ জুলাই একজন নিহত ও আহত অর্ধশতাধিক এবং ২২ জুলাই তিন যুবকের লাশ উদ্ধার ও কয়েকজন আহত হন। 

অর্ধশতাধিক স্থাপনায় আগুন

আন্দোলনের সময়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জেলা কার্যালয়, পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পুলিশ বক্স, পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশের গাড়ি, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডসহ ছোটবড় অর্ধশতাধিক স্থাপনা ও কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি ২৬টি বাস ও আরও ২০টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এখনও জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসপত্র।

পুলিশ বলছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে জেলাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনায় নাশকতার আট মামলায় ১৯৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

১৮ জুলাই যেভাবে সংঘর্ষের সূত্রপাত

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ১৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে শহরের চাষাঢ়া এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেন। দুপুরে পুলিশের একাধিক টিম বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এভাবে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। বিকালে বঙ্গবন্ধু সড়ক, নবাব সলিমুল্লাহ সড়ক ও পুরাতন সড়কে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের আরেকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দিনব্যাপী সংঘর্ষে শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন।

ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন

এদিন শহরের তিনটি মার্কেট, পুলিশ বক্স, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। রাতে সাইনবোর্ড এলাকায় পিবিআইয়ের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। একইভাবে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আগুন দেওয়া হয়। এতে পুরো জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

১৯ জুলাই

শুক্রবার জুমার নামাজের পর শহরের ডিআইটি এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। তাদের প্রতিহত করতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নামেন। তিন দফায় তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গেও আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধসহ আহত হন শতাধিক শিক্ষার্থী। সন্ধ্যায় ডিআইটি এলাকার হাতিল ফার্নিচারের শোরুম, গাজছুল আজম সিটি মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর চালিয়ে মালামাল লুট করা হয়। সেইসঙ্গে নায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেড, নম পার্ক, যুব উন্নয়ন কার্যালয়, এসবি ফ্যাশন গার্মেন্টসসহ অন্তত ২০-২৫টি স্থাপনা ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। শীতল পরিবহনের ২৬টি বাসসহ ছোটবড় আরও ২০টি যানবাহনে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার, সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের আটটি পিকআপভ্যান, দুটি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রাতে সড়কের পাশের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও ইটপাটকেল ছোড়া হয়েছে।

জাতির পিতার ম্যুরাল ভাঙচুর

২০ জুলাই

শনিবার সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জ জেলাতেও কারফিউ জারি করা হয়। দুপুরে কারফিউ ভেঙে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল ও চিটাগাংরোড এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে শিমরাইল এলাকায় ইব্রাহিম খলিল মার্কেটে আগুন দেন আন্দোলনকারীরা। ওই ভবনের সাততলায় অবস্থিত হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দেওয়া হয়। খবর পেয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে ৩৭ পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে র‌্যাব। এদিন যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চার জন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ দেড় শতাধিক আহত হন।

২১ জুলাই 

রবিবার সকালেও কারফিউ ভেঙে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল ও চিটাগাংরোড এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়। এতে একজন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন। এদিন রাতে সেনাবাহিনীর টহল শুরু হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

ছোটবড় অর্ধশতাধিক স্থাপনা ও কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন

২২ জুলাই 

সোমবার সকালে সাইনবোর্ড এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হলে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তবে এদিন রাস্তায় দাঁড়াতে পারেননি তারা। যৌথ বাহিনীর অভিযানে শক্ত অবস্থানের কারণে পিছু হটে তারা। বিকাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। এরপর শনিবার শিমরাইল এলাকায় ইব্রাহিম খলিল মার্কেটে আগুন দেওয়া ভবনটিতে তল্লাশি চালিয়ে তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। আগুনে পুড়ে সেদিন তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

শহরের খানপুর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক মো. আবুল বাশার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে চলা সংঘর্ষে মারা যাওয়া দুজনের লাশ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাদের শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া ১৫৯ জন আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। অনেকের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল।’

আন্দোলনকারীদের সামনে পুলিশের অবস্থান

গ্রেফতার ১৯৪ জন 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জেলাজুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেসব ঘটনায় আটটি মামলা হয়েছে বলে জানালেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ছয়টি এবং নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও নারায়ণগঞ্জ ফায়ার স্টেশন একটি করে মামলা করেছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের ১৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও অভিযান অব্যাহত আছে।’

একপ্রকার যুদ্ধ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছি উল্লেখ করে পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘প্রথমদিকে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিল। একটা পর্যায়ে দেখতে পেয়েছি, আন্দোলন ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে নেই। স্বাধীনতাবিরোধীরা আন্দোলনে ঢুকে নাশকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ কর্মকাণ্ড চালায়। আমরা সরকারি অফিস ও জানমাল রক্ষার্থে নাশকতাকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।’ 

রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসপত্র

জেলা ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমাদের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা আগুনে পুড়ে গেছে। সবকিছু হিসাব করলে বোঝা যাবে, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

Source link

Related posts

মুন্সিগঞ্জে আওয়ামী লীগের এক পক্ষের হামলায় অন্য পক্ষের ৯ জন আহত

News Desk

প্রথম আন্ডারপাস পাচ্ছে চট্টগ্রাম, থাকছে দোকানও

News Desk

ইমামের সঙ্গে পরকীয়ার জেরেই আজহার হত্যা, মূল পরিকল্পনাকারী স্ত্রী

News Desk

Leave a Comment