ক্ষতিপূরণ পাননি স্বজনরা, হয়নি রানার বিচার
বাংলাদেশ

ক্ষতিপূরণ পাননি স্বজনরা, হয়নি রানার বিচার

দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে নয় বছর। ২০১৩ সালের এই দিনে সাভারে ঘটেছিল দেশের ইতিহাসের নৃশংস ঘটনা। রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার নয় বছর পূর্ণ হচ্ছে রবিবার (২৩ এপ্রিল)। সেদিন কেউ বাবা-মা, কেউ ভাই-বোন, কেউ স্ত্রী-সন্তান ও স্বামীকে হারিয়েছেন। কেউ হয়ে গেছেন চিরতরে নিঃস্ব। এখনও কেউ কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে সঙ্গী করে চলছেন। এতগুলো প্রাণহানির ঘটনায় সোহেল রানার বিচার হয়নি। আজও আহত ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হয়নি ক্ষতিপূরণ। এই নৃশংস মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি। 

যা ছিল রানা প্লাজায়

সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজার ভবনটি ছিল নয়তলা। ভবনের প্রথমতলায় ছিল বিভিন্ন দোকান। দোতলায় ছিল দোকান আর বাংক। তিনতলায় নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চার ও পাঁচতলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে এবং ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেড, ছয় ও সাততলায় ছিল ইথারটেক্স লিমিটেড গার্মেন্টস। আট ও নয়তলায়ও ছিল পোশাক কারখানা। শ্রমিকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভবনের তিনতলা থেকে নয়তলা পর্যন্ত ছিল পাঁচটি পোশাক কারখানা। 

এতে প্রায় চার হাজার পোশাকশ্রমিক কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো ওই দিন সকাল ৮টায় হাজির হন কর্মস্থলে। উৎপাদনও শুরু করেন নির্ধারিত সময়ে। হঠাৎ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিকট শব্দ। আশপাশে উড়তে থাকে ধুলাবালু। ধসে পড়ে রানা প্লাজা। শুরু হয় শ্রমিকদের আহাজারি। উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। চলে বিরতিহীন উদ্ধার অভিযান। ভবন ধসের সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চাপা পড়েন চার হাজার পোশাকশ্রমিক। বাঁচাও, পানি দাও, আমার হাতটি কেটে বের করো; এমন নানা আহাজারিতে ভারী হয়ে ‍উঠে চারপাশ।

আরও পড়ুন: রানা প্লাজা ধসের বিচার চেয়ে কাঁদলেন রাব্বির মা

আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে মহাসড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় অ্যাম্বুলেন্স। তাদের হাসপাতালে পাঠানো, প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়াসহ সব ধরনের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ছুটে আসেন হাজারো স্বেচ্ছাসেবী। একে একে বের করা হয় আহত ও নিহতদের। 

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লাশের সংখ্যা বেড়ে যায়। হাসপাতালের মর্গ ভর্তি হয়ে যায়। পরে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া সাভারের অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে। স্কুল বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে লাশ রেখে দেওয়া হয়। 

হতাহতের সংখ্যা

রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। দুই হাজার ৪৩৮ শ্রমিককে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আহতদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকে আবার মানসিক রোগী হয়ে আছেন।

কালের সাক্ষী অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ

বেদনার সাক্ষী হয়ে আছে সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ। ঘটনার দিন থেকে টানা ১৭ দিন ওই বিদ্যালয়ের মাঠে নিহতদের নিয়ে রাখা হতো। আর সেখান থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হতো। প্রিয় মানুষটির সন্ধান পেতে সেসময় স্বজনরা চারদিকে ছোটাছুটি করেছেন। রানা প্লাজা থেকে বিদ্যালয়ের মাঠ দেড় কিলোমিটারজুড়ে সেসময় অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ সবাইকে জাগিয়ে তুলতো। অপেক্ষারত স্বজনরা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। এই বুঝি এলো নিখোঁজ মানুষটি। আজও সেই মাঠটি আছে, তবে নেই সেই চিত্র। তবে মাঠটি যেন আগের মতো আর হাসে না। প্রাণচঞ্চলতা হারিয়ে গেছে।

রানা প্লাজা ধসে সেদিন কেউ বাবা-মা, কেউ ভাই-বোন, কেউ স্ত্রী-সন্তান ও স্বামীকে হারিয়েছেন

অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ফরিদ জানান, আগে সকাল-দুপুর-রাত এমন কোনও সময় নেই যে মাঠে না আসতাম, কোনও ভয় ছিল না। তবে রানা প্লাজার ধসে পড়ার পর মৃত লাশগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছিল। এরপর থেকে আর সাহস পাই না।

আরও পড়ুন: রানা প্লাজা ধসের ৯ বছরেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ

উদ্ধারকাজের ৫ম দিনে (২৮ এপ্রিল) ভবনের ভেতরে একজনের প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়। কাছে গিয়ে উদ্ধারকর্মীরা জানতে পারেন তার নাম শাহীনা। তাকে বাঁচাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কায়কোবাদ নামে এক উদ্ধারকর্মী গুরুতর আহত হন। টানা সাতদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ৫ মে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান শাহীনা।

ভবন ধসের ১৭তম দিনে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করার আগ মুহূর্তে ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে পাওয়া যায় আরেকজনের প্রাণের স্পন্দন। অলৌকিকভাবে চারটি বিস্কুট ও এক বোতল পানি খেয়ে বেঁচে ছিল রেশমা। ১৭তম দিন বিকাল ৩টার দিকে ভেতর থেকে তাকে কাঠি নাড়াতে দেখেন উদ্ধারকর্মীরা। পরে রেশমাকে জীবিত দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে সাভারের সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া রেশমাকে দেখতে হাসপাতালে হেলিকপ্টারযোগে ছুটে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের ব্যক্তিবর্গ।

২০তম দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রানা প্লাজার উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেন উদ্ধারকাজে গঠিত সমন্বয় কমিটির প্রধান নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী। তিনি উদ্ধারকাজ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এক হাজার ১৩৬ জনের মৃত্যু ও দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধারের কথা জানান। পরদিন জায়গাটি ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন করেছে আহত শ্রমিক, নিহতদের স্বজন ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা

এদিকে, শনিবার বিকালে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন শ্রমিকনেতা, রানা প্লাজার আহত ও নিহতদের স্বজনরা।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘নয় বছর পার হওয়ার পথে। অথচ এই ঘটনার মূলহোতা সোহেল রানার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়নি। এখন পর্যন্ত হতাহত শ্রমিকদের দেওয়া হয়নি ক্ষতিপূরণ। করা হয়নি চিকিৎসার ব্যবস্থা। এজন্য আজও এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছি আমরা। রানা প্লাজার জায়গা অধিগ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও পরিবারের পুনর্বাসন এবং ২৪ এপ্রিলকে শোক দিবস ঘোষণা করার দাবি জানাই।’ 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘শুধুমাত্র রানা প্লাজা নয়, তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ড, স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ভবন ধসসহ এ পর্যন্ত দেশের যেসব গার্মেন্টেসে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। তাই সোহেল রানাসহ সব অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানাই।’

শনিবার বিকালে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল ইসলাম মিন্টু বলেন, ‘রানা প্লাজার ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের এখন পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হয়নি। যখনই ২৪ এপ্রিল আসে বিচার নিয়ে কথা ওঠে। কিন্তু বছরের বাকি ১১ মাস এ নিয়ে কোনও কথা হয় না। শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে কারখানাগুলো নিরাপদ করতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল। এরপর অ্যাকোর্ড, অ্যালায়েন্স এসেছে। কিন্তু কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। এখনও বিভিন্ন কারখানায় ঘটছে দুর্ঘটনা। শ্রমিকরা জীবন দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এখনও রানা প্লাজার যেসব শ্রমিক জীবিত আছেন তারা এই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আসতে চাইলে কারখানার মালিকরা ছুটি দেন না। সরকার ও কারখানার মালিকরা এই দিন ভুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমরা এ ঘটনার বিচার চাই এবং চাইবো।’

রানা প্লাজার আহত শ্রমিক নিলুফা আক্তার বলেন, ‘আমি ক্ষতিপূরণ চাই। আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। পাশাপাশি রানার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করুন।’

রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিক রাব্বির মা রাহেলা খাতুন বলেন, ‘ছেলে হারানোর নয় বছর হলো। কিন্তু আমরা বিচার পেলাম না। দোষীদের বিচার এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার।’ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

Source link

Related posts

বিএনপিকে চিরতরে বয়কট করেছে দেশের মানুষ: এমপি কাজী নাবিল

News Desk

ঘুরতে বেরিয়ে সড়কে শেষ দুটি পরিবার, আনন্দ রূপ নিলো বিষাদে

News Desk

আজ তার চলে যাওয়ার দিন

News Desk

Leave a Comment