খাবারের কষ্টে দিন কাটানো কিশোরের জাতীয় রেকর্ড
বাংলাদেশ

খাবারের কষ্টে দিন কাটানো কিশোরের জাতীয় রেকর্ড

‘আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ইভেন্ট করতে আমার শরীরে অনেক ঘাটতি হয়। কিন্তু আমি ভালো খাবার দাবার পাই না। আমার ভালো খাবার দরকার। আমি সেটা জোগাড় করতে পারি না। লং ইভেন্টে অনেক কষ্ট হয়।’ কথাগুলো বলছিল শেখ কামাল ৩৮তম জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা-২০২৪ এর অনূর্ধ্ব-১৮ কিশোর বিভাগে ১৫০০ মিটার দৌড়ে জাতীয় রেকর্ড গড়া কিশোর মোহাম্মদ শাওন।

সে কুড়িগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে শেখ কামাল ৩৮তম জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। গত ২৪ মে (শুক্রবার) সকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে হওয়া এই প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী দি‌নে অনূর্ধ্ব-১৮ কিশোর বিভাগে ১৫০০ মিটার দৌড়ে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করে শাওন। এ জন‌্য তি‌নি সময় নিয়েছে মাত্র চার মিনিট ১৪.১২ সেকেন্ড। শেষ মুহূর্তে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কিশোরের সঙ্গে তার দূরত্ব ছিল কয়েক মিটার। পাঁচ বছর আগে এই ইভেন্টে রেকর্ড ছিল নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার বিজয় মল্লিকের। ২০১৮ সালে ওই রেকর্ড গড়তে সময় নিয়েছিল ছয় মিনিট ১৯.২০ সেকেন্ড।

শাওনের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মাস্টার পাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের দিনমজুর মোফাচ্ছেল হক বাচ্চু ও মোছা. সাবিনা দম্পতির চার ছেলের মধ্যে বড় শাওন। পরিবার ও এলাকায় সাব্বির নামে পরিচিত। স্থানীয় একটি দাখিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। দারিদ্র্যের কষাঘাত আর অভাবের সংসারের এই কিশোর দিনমজুরের কাজ করে নিজের লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি খেলাধুলার চালিয়ে আসছেন। মাত্র ছয় মাসের প্রশিক্ষণ আর কঠোর পরিশ্রমে দৌড় প্রতিযোগিতায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এবার নতুন জাতীয় রেকর্ড গড়েছে। শাওনের এমন সফলতার আনন্দস্রোত ঢাকা থেকে গড়িয়েছে তার বাড়ি ও মহল্লায়। সেখানে আনন্দে ভাসছেন সবাই।

শাওন বলে, ‘আমি অনেক কষ্ট করে প্রতিদিন বাইসাইকেলে করে গিয়ে কুড়িগ্রাম স্টেডিয়ামে প্রাকটিস করতাম। ভালো খাবারের অভাবে শরীর সাপোর্ট করতো না, কিন্তু আমি নিজের সঙ্গে জোর করে প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছি। ৫-৬ মাসের প্র্যাকটিসে আমি এই সফলতা পেয়েছি।’

নিজের এই সফলতায় কোচের অবদানের কথা স্মরণ করে শাওন বলে, ‘আমার কোচ আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমার সফলতায় তার অবদান অনেক। এবার জুনিয়র প্রতিযোগিতায় সফল হয়েছি। আগামীতে সিনিয়র প্রতিযোগিতায় রেকর্ড গড়তে চাই।’

কোচ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শাওন অনেক পরিশ্রমী। অনেক কষ্ট করে সে এই সফলতার নাগাল পেয়েছে। এই তরুণকে তৈরি করতে আমাকেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় ওকে নিজের টাকা দিয়ে রানিং সু (জুতা) কিনেও দিয়েছি। ওর সামনের দিনগুলো আরও সাফল্যমণ্ডিত হোক, এটাই কামনা করি।’

ঢাকার মাঠে রেকর্ড স্পর্শ করার পর সম্প্রতি শাওনের বাড়িতে যান এই প্রতিবেদক। শাওন তখনও ঢাকায়। বাড়িতে দেখা মেলে তার মা, ভাই ও স্বজনদের। তপ্ত রোদে শাওনের মা সাবিনা সড়কে খড় শুকাচ্ছিলেন। ছেলের এমন সফলতায় নিজের আনন্দ আর স্বস্তির কথা জানালেন। বললেন শাওনের কষ্টের কথা।

মা-দাদির সঙ্গে শাওন

রেকর্ড গড়া কিশোরের এই মা বলেন, ‘ওর খেলাধুলায় খুব আগ্রহ। টাকা দিবার পাই না। সাইকেল নিয়া কুড়িগ্রাম গিয়া খেলা করে। কাজ করি নিজের খরচ নিজে চালায়।’

‘চারটা ছেলে। হামরা ভালো খাবার দিবার পাই না। একজনকে ভালো খাওয়াইলে সবাকে খাওয়ান লাগে। সেটাতো জোগবার পাই না। খাবারের কষ্ট নিয়া খেলাধুলা করছে। সরকার ওর দায়িত্ব নিলে ভালো হইলো হয়,’ শাওনের খাবার ও যত্ন প্রশ্নে বলেন সাবিনা।

শাওনের রেকর্ড গড়া বিজয়ের আনন্দ ছুঁয়েছে তার বয়োবৃদ্ধ দাদির হৃদয়ও। নাতির কষ্টের কথা স্মরণ করে দাদি মানিজন বলেন, ‘খবর পায়া খুশি হইছি। হামরাতো পুষ্টি মুষ্টি খাওয়াবার পাই না। যেভাবে জিতছে সেটা আল্লাহর ইচ্ছায়। সবাই দোয়া করবেন যেন আরও ভালো করে।’

শাওনের বাবা বাড়ি ছিলেন না। তিনি কৃষি শ্রমিকের কাজ করতে জেলার বাইরে অবস্থান করছেন। তবে ফোনে ছেলের সফলতার খবর পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছে শাওনের পরিবার।

ঢাকায় শাওনের সঙ্গে সফ‌রে থাকা কুড়িগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি সাঈদ হাসান লোবান বলেন, ‘শাওনের রেকর্ড গড়া সফলতায় আমরা অনেক খুশি ও গর্বিত। জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে ওর জন্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’

Source link

Related posts

সিলেটে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় ৫ পুলিশ আহত, আটক ৮ বিএনপি নেতাকর্মী

News Desk

রাতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল আদায়ে বিপত্তি, যানবাহনে ধীরগতি

News Desk

দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না: প্রধানমন্ত্রী

News Desk

Leave a Comment